১০:৪৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

উত্তরের ছোট্ট ধারা ‘চিড়ি’ নদী: যমুনা থেকে এসে তুসলীগঙ্গায় মিশে গেছে

উত্তরবঙ্গের ছোট নদীগুলোর মধ্যে চিড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। জয়পুরহাট ও দিনাজপুর ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদকৃষি এবং হাট-বাজারের সাথে এই নদীর দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। আকারে ছোট হলেও এটি এ অঞ্চলের পানিসম্পদজীববৈচিত্র্যগ্রামীণ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত।

উৎপত্তি ও গতিপথ
স্থানীয় ও সরকারি সূত্র অনুযায়ীচিড়ি নদীর উৎস ছোট যমুনা নদী। এটি জয়পুরহাট অঞ্চলে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বয়ে এসে তুলসীগঙ্গা নদীতে মিশে যায়। ফলে এটি ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গার মাঝে একটি প্রাকৃতিক সংযোগধারা হিসেবে কাজ করে। তথ্যসূত্রে নামের বানান ও দৈর্ঘ্য নিয়ে কিছু পার্থক্য আছেবাংলা উইকিতে চিড়ি নদীর দৈর্ঘ্য ২২ কিমি বলা হয়েছে

নদীর পরিমিতি ও অবস্থান
অবস্থান: রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলাপাশাপাশি দিনাজপুর ও নওগাঁর উপকণ্ঠে প্রভাব রয়েছে।

উৎস ও মোহনা: উৎস ছোট যমুনামোহনা তুলসীগঙ্গা নদী।

দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ: এক সূত্রে প্রায় ২২ কিমি দৈর্ঘ্য ও গড় প্রস্থ ২৫ মিটার বলা হয়েছেঅন্য সূত্রে ২১.৭ কিমি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় ১৫ মিটার উল্লেখ আছে।

অতীতে নৌবাণিজ্যের গুরুত্ব
ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে মৌসুমি নৌবাণিজ্যে ছোট নদীগুলোর অবদান ছিল বিশাল। চিরিরবন্দর এলাকার ইতিহাসে পাওয়া যায়নদীপথে বড় বড় নাওয়ে পণ্য আনা-নেওয়া হতোআর নদীর ঘাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হাট ও বন্দর। এখান থেকেই চিরিরবন্দর” নামের উৎপত্তি বলে জানা যায়। চিড়ি নদী মৌসুমি যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

বর্তমান ব্যবহার ও উপকারিতা
সেচ ও কৃষি: বর্ষা ও বর্ষা-উত্তর মৌসুমে এর পানি ধানগমভুট্টা ও সবজি চাষে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়।

মৎস্যসম্পদ: নদীর সাথে খালবিল ও ডোবার সংযোগ থাকায় এটি দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ: অতিবৃষ্টির সময় বা উজান থেকে পানি নামলে এটি প্রাকৃতিক নিষ্কাশনপথ হিসেবে কাজ করেজলাবদ্ধতা কমায়।

গ্রামীণ যোগাযোগ ও সংস্কৃতি: ঘাটমেলানৌযাত্রা এবং নদীকে ঘিরে লোকসংস্কৃতির প্রচলন এখনো রয়েছে।

কেন এই নদী গুরুত্বপূর্ণ
কৃষি ও জীবিকা: সেচমাছধরাপশুপালনের পানিসরবরাহসবই এ নদীর সাথে সম্পর্কিত।

জীববৈচিত্র্য: মৌসুমি প্লাবন জলজ উদ্ভিদপাখি ও দেশি মাছের আবাসস্থল বজায় রাখে।

বন্যা ঝুঁকি হ্রাস: স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকলে আকস্মিক বন্যা ও ভাঙন কম হয়।

ঐতিহ্য রক্ষা: নদীঘাটহাট-বাজার ও নৌ-ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে এটি স্থানীয় পরিচয়ের অংশ।

বর্তমান সঙ্কট
বর্তমানে চিড়ি নদী পলি জমে ভরাটদখল ও দূষণের শিকার। কিছু স্থানে শুষ্ক মৌসুমে এটি প্রায় খালে পরিণত হয় এবং জমি আবাদে ব্যবহৃত হয়। জয়পুরহাটের চারটি নদীছোট যমুনাতুলসীগঙ্গাহরবতী ও চিড়িশুকিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নদীশাসন ও সময়মতো খননের অভাবে এর প্রবাহ ক্রমশ কমছে।

সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের করণীয়
নিয়মিত খনন: উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সংযোগ রক্ষা করে পর্যায়ক্রমে খনন।

নদীতীর সুরক্ষা: প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁধ ও প্রাকৃতিক উদ্ভিদ দিয়ে তীর সংরক্ষণ।

আইন প্রয়োগ: দখলমুক্তকরণঅবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও মৎসমহাল ব্যবস্থাপনায় টেকসই নীতি প্রয়োগ।

বৃষ্টিনির্ভর পানি সংরক্ষণ: জলাধাররেইনওয়াটার হারভেস্টিং এবং বিল সংরক্ষণ।

কমিউনিটি অংশগ্রহণ: কৃষকজেলে ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।

গুরুত্বপূর্ণ জলধারা

চিড়ি নদী উত্তরবঙ্গের ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলধারা। উৎস ছোট যমুনা থেকে উঠে এসে তুলসীগঙ্গায় মিশে যাওয়া এই নদী শুধু পানির উৎস নয়বরং এ অঞ্চলের কৃষিমৎস্যসংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। যথাযথ খননদখলমুক্তকরণ এবং স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে এই নদী আবারও সারা বছর এলাকার মানুষের জীবিকা ও সংস্কৃতিকে সমর্থন করবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

উত্তরের ছোট্ট ধারা ‘চিড়ি’ নদী: যমুনা থেকে এসে তুসলীগঙ্গায় মিশে গেছে

০৮:০০:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫

উত্তরবঙ্গের ছোট নদীগুলোর মধ্যে চিড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। জয়পুরহাট ও দিনাজপুর ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদকৃষি এবং হাট-বাজারের সাথে এই নদীর দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। আকারে ছোট হলেও এটি এ অঞ্চলের পানিসম্পদজীববৈচিত্র্যগ্রামীণ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত।

উৎপত্তি ও গতিপথ
স্থানীয় ও সরকারি সূত্র অনুযায়ীচিড়ি নদীর উৎস ছোট যমুনা নদী। এটি জয়পুরহাট অঞ্চলে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বয়ে এসে তুলসীগঙ্গা নদীতে মিশে যায়। ফলে এটি ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গার মাঝে একটি প্রাকৃতিক সংযোগধারা হিসেবে কাজ করে। তথ্যসূত্রে নামের বানান ও দৈর্ঘ্য নিয়ে কিছু পার্থক্য আছেবাংলা উইকিতে চিড়ি নদীর দৈর্ঘ্য ২২ কিমি বলা হয়েছে

নদীর পরিমিতি ও অবস্থান
অবস্থান: রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলাপাশাপাশি দিনাজপুর ও নওগাঁর উপকণ্ঠে প্রভাব রয়েছে।

উৎস ও মোহনা: উৎস ছোট যমুনামোহনা তুলসীগঙ্গা নদী।

দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ: এক সূত্রে প্রায় ২২ কিমি দৈর্ঘ্য ও গড় প্রস্থ ২৫ মিটার বলা হয়েছেঅন্য সূত্রে ২১.৭ কিমি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় ১৫ মিটার উল্লেখ আছে।

অতীতে নৌবাণিজ্যের গুরুত্ব
ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে মৌসুমি নৌবাণিজ্যে ছোট নদীগুলোর অবদান ছিল বিশাল। চিরিরবন্দর এলাকার ইতিহাসে পাওয়া যায়নদীপথে বড় বড় নাওয়ে পণ্য আনা-নেওয়া হতোআর নদীর ঘাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হাট ও বন্দর। এখান থেকেই চিরিরবন্দর” নামের উৎপত্তি বলে জানা যায়। চিড়ি নদী মৌসুমি যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

বর্তমান ব্যবহার ও উপকারিতা
সেচ ও কৃষি: বর্ষা ও বর্ষা-উত্তর মৌসুমে এর পানি ধানগমভুট্টা ও সবজি চাষে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়।

মৎস্যসম্পদ: নদীর সাথে খালবিল ও ডোবার সংযোগ থাকায় এটি দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

বন্যা নিয়ন্ত্রণ: অতিবৃষ্টির সময় বা উজান থেকে পানি নামলে এটি প্রাকৃতিক নিষ্কাশনপথ হিসেবে কাজ করেজলাবদ্ধতা কমায়।

গ্রামীণ যোগাযোগ ও সংস্কৃতি: ঘাটমেলানৌযাত্রা এবং নদীকে ঘিরে লোকসংস্কৃতির প্রচলন এখনো রয়েছে।

কেন এই নদী গুরুত্বপূর্ণ
কৃষি ও জীবিকা: সেচমাছধরাপশুপালনের পানিসরবরাহসবই এ নদীর সাথে সম্পর্কিত।

জীববৈচিত্র্য: মৌসুমি প্লাবন জলজ উদ্ভিদপাখি ও দেশি মাছের আবাসস্থল বজায় রাখে।

বন্যা ঝুঁকি হ্রাস: স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকলে আকস্মিক বন্যা ও ভাঙন কম হয়।

ঐতিহ্য রক্ষা: নদীঘাটহাট-বাজার ও নৌ-ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে এটি স্থানীয় পরিচয়ের অংশ।

বর্তমান সঙ্কট
বর্তমানে চিড়ি নদী পলি জমে ভরাটদখল ও দূষণের শিকার। কিছু স্থানে শুষ্ক মৌসুমে এটি প্রায় খালে পরিণত হয় এবং জমি আবাদে ব্যবহৃত হয়। জয়পুরহাটের চারটি নদীছোট যমুনাতুলসীগঙ্গাহরবতী ও চিড়িশুকিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নদীশাসন ও সময়মতো খননের অভাবে এর প্রবাহ ক্রমশ কমছে।

সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের করণীয়
নিয়মিত খনন: উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সংযোগ রক্ষা করে পর্যায়ক্রমে খনন।

নদীতীর সুরক্ষা: প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁধ ও প্রাকৃতিক উদ্ভিদ দিয়ে তীর সংরক্ষণ।

আইন প্রয়োগ: দখলমুক্তকরণঅবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও মৎসমহাল ব্যবস্থাপনায় টেকসই নীতি প্রয়োগ।

বৃষ্টিনির্ভর পানি সংরক্ষণ: জলাধাররেইনওয়াটার হারভেস্টিং এবং বিল সংরক্ষণ।

কমিউনিটি অংশগ্রহণ: কৃষকজেলে ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।

গুরুত্বপূর্ণ জলধারা

চিড়ি নদী উত্তরবঙ্গের ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলধারা। উৎস ছোট যমুনা থেকে উঠে এসে তুলসীগঙ্গায় মিশে যাওয়া এই নদী শুধু পানির উৎস নয়বরং এ অঞ্চলের কৃষিমৎস্যসংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। যথাযথ খননদখলমুক্তকরণ এবং স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে এই নদী আবারও সারা বছর এলাকার মানুষের জীবিকা ও সংস্কৃতিকে সমর্থন করবে।