উত্তরবঙ্গের ছোট নদীগুলোর মধ্যে চিড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। জয়পুরহাট ও দিনাজপুর ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদ, কৃষি এবং হাট-বাজারের সাথে এই নদীর দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। আকারে ছোট হলেও এটি এ অঞ্চলের পানিসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, গ্রামীণ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত।
উৎপত্তি ও গতিপথ
স্থানীয় ও সরকারি সূত্র অনুযায়ী, চিড়ি নদীর উৎস ছোট যমুনা নদী। এটি জয়পুরহাট অঞ্চলে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বয়ে এসে তুলসীগঙ্গা নদীতে মিশে যায়। ফলে এটি ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গার মাঝে একটি প্রাকৃতিক সংযোগধারা হিসেবে কাজ করে। তথ্যসূত্রে নামের বানান ও দৈর্ঘ্য নিয়ে কিছু পার্থক্য আছে—বাংলা উইকিতে চিড়ি নদীর দৈর্ঘ্য ২২ কিমি বলা হয়েছে।
নদীর পরিমিতি ও অবস্থান
অবস্থান: রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলা, পাশাপাশি দিনাজপুর ও নওগাঁর উপকণ্ঠে প্রভাব রয়েছে।
উৎস ও মোহনা: উৎস ছোট যমুনা; মোহনা তুলসীগঙ্গা নদী।
দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ: এক সূত্রে প্রায় ২২ কিমি দৈর্ঘ্য ও গড় প্রস্থ ২৫ মিটার বলা হয়েছে, অন্য সূত্রে ২১.৭ কিমি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় ১৫ মিটার উল্লেখ আছে।

অতীতে নৌবাণিজ্যের গুরুত্ব
ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে মৌসুমি নৌবাণিজ্যে ছোট নদীগুলোর অবদান ছিল বিশাল। চিরিরবন্দর এলাকার ইতিহাসে পাওয়া যায়—নদীপথে বড় বড় নাওয়ে পণ্য আনা-নেওয়া হতো, আর নদীর ঘাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হাট ও বন্দর। এখান থেকেই “চিরিরবন্দর” নামের উৎপত্তি বলে জানা যায়। চিড়ি নদী মৌসুমি যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।
বর্তমান ব্যবহার ও উপকারিতা
সেচ ও কৃষি: বর্ষা ও বর্ষা-উত্তর মৌসুমে এর পানি ধান, গম, ভুট্টা ও সবজি চাষে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়।
মৎস্যসম্পদ: নদীর সাথে খাল, বিল ও ডোবার সংযোগ থাকায় এটি দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ: অতিবৃষ্টির সময় বা উজান থেকে পানি নামলে এটি প্রাকৃতিক নিষ্কাশনপথ হিসেবে কাজ করে, জলাবদ্ধতা কমায়।
গ্রামীণ যোগাযোগ ও সংস্কৃতি: ঘাট, মেলা, নৌযাত্রা এবং নদীকে ঘিরে লোকসংস্কৃতির প্রচলন এখনো রয়েছে।

কেন এই নদী গুরুত্বপূর্ণ
কৃষি ও জীবিকা: সেচ, মাছধরা, পশুপালনের পানিসরবরাহ—সবই এ নদীর সাথে সম্পর্কিত।
জীববৈচিত্র্য: মৌসুমি প্লাবন জলজ উদ্ভিদ, পাখি ও দেশি মাছের আবাসস্থল বজায় রাখে।
বন্যা ঝুঁকি হ্রাস: স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকলে আকস্মিক বন্যা ও ভাঙন কম হয়।
ঐতিহ্য রক্ষা: নদীঘাট, হাট-বাজার ও নৌ-ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে এটি স্থানীয় পরিচয়ের অংশ।
বর্তমান সঙ্কট
বর্তমানে চিড়ি নদী পলি জমে ভরাট, দখল ও দূষণের শিকার। কিছু স্থানে শুষ্ক মৌসুমে এটি প্রায় খালে পরিণত হয় এবং জমি আবাদে ব্যবহৃত হয়। জয়পুরহাটের চারটি নদী—ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, হরবতী ও চিড়ি—শুকিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নদীশাসন ও সময়মতো খননের অভাবে এর প্রবাহ ক্রমশ কমছে।

সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের করণীয়
নিয়মিত খনন: উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সংযোগ রক্ষা করে পর্যায়ক্রমে খনন।
নদীতীর সুরক্ষা: প্রয়োজন অনুযায়ী বাঁধ ও প্রাকৃতিক উদ্ভিদ দিয়ে তীর সংরক্ষণ।
আইন প্রয়োগ: দখলমুক্তকরণ, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও মৎসমহাল ব্যবস্থাপনায় টেকসই নীতি প্রয়োগ।
বৃষ্টিনির্ভর পানি সংরক্ষণ: জলাধার, রেইনওয়াটার হারভেস্টিং এবং বিল সংরক্ষণ।
কমিউনিটি অংশগ্রহণ: কৃষক, জেলে ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।
গুরুত্বপূর্ণ জলধারা
চিড়ি নদী উত্তরবঙ্গের ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলধারা। উৎস ছোট যমুনা থেকে উঠে এসে তুলসীগঙ্গায় মিশে যাওয়া এই নদী শুধু পানির উৎস নয়, বরং এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অংশ। যথাযথ খনন, দখলমুক্তকরণ এবং স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে এই নদী আবারও সারা বছর এলাকার মানুষের জীবিকা ও সংস্কৃতিকে সমর্থন করবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















