১০:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

১৫ আগস্ট ১৯৭৫: এক রক্তাক্ত প্রভাতের ইতিহাস

স্বাধীনতার স্থপতির নির্মম পরিণতি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অকৃত্রিম নেতা। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে তিনি তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

পটভূমি: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক সংকট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্তকে বিরোধীরা স্বৈরাচারী পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরে। এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে একদল সেনা কর্মকর্তা ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে।

রহস্যঘেরা ১৫ই আগস্ট

হত্যার ভোর: ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের রক্তাক্ত সকাল

১৫ আগস্ট শুক্রবার, ভোর রাত সাড়ে ৪টার দিকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও ভারী অস্ত্র নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িকে ঘিরে ফেলে।
প্রথমে বাড়ির গেট ভেঙে প্রবেশ করে তারা প্রাসাদোপম বাড়ির ভেতরে প্রবল গুলিবর্ষণ শুরু করে। এরপর একে একে গুলি ও বেয়নেট আঘাতে নিহত হন—

  • • শেখ মুজিবুর রহমান
  • • তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব
  • • পুত্র শেখ কামাল,শেখ জামাল এবং শিশু শেখ রাসেল
  • • দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল
  • • বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের,দুলাভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য
    শুধু দুই কন্যা—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা—সেদিন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

হত্যাকারীরা ও তাদের উদ্দেশ্য

এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে সেনাবাহিনীর কিছু বিদ্রোহী কর্মকর্তা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল ফারুক রহমান, কর্নেল রশিদসহ কয়েকজন মেজর ও ক্যাপ্টেন। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ পাল্টাতে চেয়েছিল। পরদিনই খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েও মোশতাক এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আজ জাতিসংঘ দিবস

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিধ্বনি

হত্যার পর দেশে সামরিক আইন জারি হয়। বিদেশি গণমাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘একটি স্বাধীন জাতির স্বপ্নের নির্মম মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করা হয়। ভারতসহ অনেক দেশ গভীর শোক প্রকাশ করলেও কিছু রাষ্ট্র নীরবতা বজায় রাখে।

জাতিসংঘে এ ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও তখনকার বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোনো বড় ধরনের আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচারের সংগ্রাম

১৯৭৫ সালের পরবর্তী সরকারগুলো ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করে হত্যাকারীদের বিচার থেকে রক্ষা দেয়। প্রায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে এই আইন বাতিল করেন এবং হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১০ সালে পাঁচজন হত্যাকারীর ফাঁসি কার্যকর হয়, তবে কয়েকজন বিদেশে পলাতক থেকে যায়, যাদের এখনো দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

ইতিহাসের শিক্ষা

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড আমাদের শেখায়—রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র শুধু অর্জনের মাধ্যমে স্থায়ী হয় না; তা রক্ষায় প্রয়োজন সতর্কতা, ঐক্য এবং সত্যের প্রতি অটল অবস্থান। জাতির পিতার হত্যা শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য এক শোকগাথা।

আজও ইতিহাস সেই ভোরের রক্তাক্ত স্মৃতি ধরে রেখেছে, যা বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরকাল এক অপূরণীয় ক্ষত হয়ে থাকবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

১৫ আগস্ট ১৯৭৫: এক রক্তাক্ত প্রভাতের ইতিহাস

০৭:৩৭:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ২০২৫

স্বাধীনতার স্থপতির নির্মম পরিণতি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অকৃত্রিম নেতা। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে তিনি তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

পটভূমি: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক সংকট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্তকে বিরোধীরা স্বৈরাচারী পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরে। এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে একদল সেনা কর্মকর্তা ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে।

রহস্যঘেরা ১৫ই আগস্ট

হত্যার ভোর: ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের রক্তাক্ত সকাল

১৫ আগস্ট শুক্রবার, ভোর রাত সাড়ে ৪টার দিকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও ভারী অস্ত্র নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িকে ঘিরে ফেলে।
প্রথমে বাড়ির গেট ভেঙে প্রবেশ করে তারা প্রাসাদোপম বাড়ির ভেতরে প্রবল গুলিবর্ষণ শুরু করে। এরপর একে একে গুলি ও বেয়নেট আঘাতে নিহত হন—

  • • শেখ মুজিবুর রহমান
  • • তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব
  • • পুত্র শেখ কামাল,শেখ জামাল এবং শিশু শেখ রাসেল
  • • দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল
  • • বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের,দুলাভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য
    শুধু দুই কন্যা—শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা—সেদিন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।

হত্যাকারীরা ও তাদের উদ্দেশ্য

এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে সেনাবাহিনীর কিছু বিদ্রোহী কর্মকর্তা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল ফারুক রহমান, কর্নেল রশিদসহ কয়েকজন মেজর ও ক্যাপ্টেন। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ পাল্টাতে চেয়েছিল। পরদিনই খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েও মোশতাক এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আজ জাতিসংঘ দিবস

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিধ্বনি

হত্যার পর দেশে সামরিক আইন জারি হয়। বিদেশি গণমাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘একটি স্বাধীন জাতির স্বপ্নের নির্মম মৃত্যু’ বলে উল্লেখ করা হয়। ভারতসহ অনেক দেশ গভীর শোক প্রকাশ করলেও কিছু রাষ্ট্র নীরবতা বজায় রাখে।

জাতিসংঘে এ ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও তখনকার বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোনো বড় ধরনের আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচারের সংগ্রাম

১৯৭৫ সালের পরবর্তী সরকারগুলো ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করে হত্যাকারীদের বিচার থেকে রক্ষা দেয়। প্রায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে এই আইন বাতিল করেন এবং হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১০ সালে পাঁচজন হত্যাকারীর ফাঁসি কার্যকর হয়, তবে কয়েকজন বিদেশে পলাতক থেকে যায়, যাদের এখনো দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

ইতিহাসের শিক্ষা

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড আমাদের শেখায়—রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র শুধু অর্জনের মাধ্যমে স্থায়ী হয় না; তা রক্ষায় প্রয়োজন সতর্কতা, ঐক্য এবং সত্যের প্রতি অটল অবস্থান। জাতির পিতার হত্যা শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য এক শোকগাথা।

আজও ইতিহাস সেই ভোরের রক্তাক্ত স্মৃতি ধরে রেখেছে, যা বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরকাল এক অপূরণীয় ক্ষত হয়ে থাকবে।