নতুন সংকট: রাংপানিতে লুটপাট
সিলেটের সাদাপাথর ও জাফলংয়ে লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে প্রশাসন উদ্যোগ নেওয়ার পরপরই জৈন্তাপুর উপজেলার রাংপানি পর্যটনকেন্দ্রে শুরু হয়েছে একই ধরনের লুটপাট। প্রাকৃতিকভাবে গঠিত এই জল-নুড়ি-পাথরের স্থান এখন অসাধুদের দখলে। স্থানীয়দের অভিযোগ—এই লুটের সঙ্গে জড়িত কিছু রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসৎ সদস্যরা।
কয়েক বছরের পুরোনো লুট, সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে
রাংপানিতে পাথর লুট চলছে কয়েক বছর ধরেই। তবে ২০২৩ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে এই লুটপাট আরও বেড়েছে। শ্রমিকরা সীমান্তের ওপার থেকেও পাথর সংগ্রহ করছে। স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এই লুটপাট চলছে।
লুটের চিত্র
স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রতিদিন আট থেকে দশটি বারকি নৌকায় পাথর বহন করা হয়। টিলা কেটে বড় গর্ত করে পাথর তোলা হয়, পরে হ্যামার দিয়ে ভেঙে নৌকায় ভরা হয়। শ্রমিকরা সবসময় নজর রাখে কে আসছে-যাচ্ছে। কেউ ছবি বা ভিডিও তুলতে চাইলে আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে চাঁদাবাজি
আগে আওয়ামী লীগের সমর্থনে লুট হতো, এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন নেতা। শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে টাকা তোলা হয়। প্রতি বারকি নৌকার ট্রিপে ৮০০ টাকা এবং ট্রাক প্রতি প্রায় ৩ হাজার টাকা নেওয়া হয়। একটি নৌকা প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ ট্রিপ দিতে পারে।
পাথর প্রথমে রাখা হয় রাংপানি ক্যাপ্টেন রশিদ স্কুল অ্যান্ড কলেজের পেছনে, পরে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
অভিযুক্তদের নাম
অভিযোগ উঠেছে, জৈন্তাপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল আহাদ, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীপুর পাথর কোয়ারির সাধারণ সম্পাদক দিলদার হোসেন, সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন এবং জামায়াত নেতা আমির নূরুল ইসলাম এ লুটপাটে জড়িত।
তবে সবাই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কেউ বলেছেন, তাদের নাম রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে; কেউ বলেছেন, তারা ঘাটের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন।
ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের বক্তব্য
বিভিন্ন ঘাট ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, তাদের ঘাট দীর্ঘদিন বন্ধ। কেউ কেউ দাবি করেছেন, জেল খেটে বের হওয়ার পর ঘাটে আর যান না। অন্যরা বলেছেন, তাদের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং এখন তারা অন্য ব্যবসায় জড়িত।
কিন্তু স্থানীয়রা বলেন, বাস্তবে পাথর তোলার কাজ চালাচ্ছেন শ্রীপুর পাথর কোয়ারি সমিতির কিছু সদস্য। এছাড়া আদর্শগ্রাম বালুরসাইটও অন্য একটি দল পরিচালনা করছে।
পরিবেশ কর্মীদের উদ্বেগ
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক কাসমির রেজা বলেছেন, “প্রশাসন যদি সাদাপাথরে কঠোর হতো, তাহলে রাংপানি বা অন্য স্পটগুলোতে লুটপাট হতো না। সিলেটের প্রায় সব পর্যটন এলাকায় বালু-পাথর লুট চলছে। কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এটি থামবে না।”
তিনি সদ্য যোগদান করা সিলেট জেলা প্রশাসককে পর্যটন স্পট রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
প্রশাসনের অভিযান
জৈন্তাপুর থানার ওসি জানিয়েছেন, পুলিশের নামে চাঁদা তোলার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জর্জ মিত্র চাকমা বলেন, “অনেকে প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে, অভিযান চলবে।”
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার লাবনী জানান, মঙ্গলবার সকালে অভিযান চালিয়ে ২৮ হাজার ঘনফুট বালু ও ২০ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। এর আগের দিনও ৩৫ ট্রাক বালু ও প্রায় ৯৫০০ ঘনফুট পাথর আটক করা হয়।
তিনি বলেন, “জনগণের সচেতনতা ছাড়া এ লুটপাট বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে ক্র্যাশার মালিকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দেওয়া হচ্ছে।”
উপসংহার
রাংপানি ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় পাথর-বালুর লুট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক আশ্রয়, প্রশাসনের দুর্বলতা আর অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। প্রশাসনের অভিযান চললেও টেকসই সমাধান পেতে হলে স্থানীয়দের সচেতনতা ও কঠোর আইন প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
সিলেটের রাংপানিতে অব্যাহত পাথর-বালুর লুট
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ১১:৩১:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫
- 96
জনপ্রিয় সংবাদ


























