আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে মুদ্রার মান একটি দেশের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। অনেক সময় কোনো দেশ ইচ্ছাকৃতভাবে বা বাজারের চাপে নিজের মুদ্রাকে অতিমূল্যায়িত (overvalued) রাখে। প্রশ্ন হলো, এটি কি দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ভালো, নাকি ক্ষতিকর?
মুদ্রার অতিমূল্যায়ন কী বোঝায়
যখন কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময় হার বাস্তব অর্থনৈতিক শক্তি, উৎপাদনশীলতা বা বাজার পরিস্থিতির তুলনায় বেশি থাকে, তখন তাকে মুদ্রার অতিমূল্যায়ন বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে ১ ডলারের প্রকৃত সমমূল্য হয় ১০০ টাকা, অথচ সরকার বা বাজার সেটিকে ৮০ টাকায় স্থির রাখে, তবে বলা যায় দেশটির মুদ্রা অতিমূল্যায়িত।
প্রাথমিক সুফল
মুদ্রার অতিমূল্যায়ন প্রাথমিকভাবে কিছু সুবিধা এনে দিতে পারে—
- আমদানির খরচ কমে যায়:বিদেশ থেকে পণ্য ও সেবা আনা সস্তা হয়ে যায়। এতে ভোক্তারা তুলনামূলক কম দামে বিদেশি পণ্য ভোগ করতে পারে।

- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে:আমদানি করা খাদ্যপণ্য, জ্বালানি বা কাঁচামাল সস্তা হলে স্থানীয় বাজারে দ্রব্যমূল্য কিছুটা স্থিতিশীল থাকে।
- বাহ্যিক ঋণ পরিশোধ সহজ হয়:যেসব দেশ বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেয়, তাদের জন্য নিজের মুদ্রার মান বেশি হলে ঋণ শোধ করা তুলনামূলক সস্তা হয়ে যায়।
সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক দিকগুলোই বেশি দেখা দেয়—
- রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়:বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য তুলনামূলক বেশি দামে পড়ে। ফলে রপ্তানি প্রতিযোগিতা কমে যায়।
- স্থানীয় শিল্প সংকটে পড়ে:আমদানি সস্তা হওয়ায় স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এতে শিল্পোদ্যোগ স্থবির হয় এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পায়।
- বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ে:রপ্তানি কমে এবং আমদানি বাড়তে থাকলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়ে।
- কালোবাজার ও মুদ্রা পাচার বাড়ে:বাস্তব বাজারের সঙ্গে সরকারি নির্ধারিত বিনিময় হারের পার্থক্য যত বাড়ে, ততই কালোবাজারে মুদ্রা ব্যবসা বেড়ে যায়।

অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
দীর্ঘমেয়াদে অতিমূল্যায়িত মুদ্রা একটি দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে তোলে। রপ্তানি খাত দুর্বল হয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে, শিল্পক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেয় এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। অনেক সময় সরকারকে পরবর্তীতে হঠাৎ করে মুদ্রার অবমূল্যায়ন (devaluation) করতে হয়, যা অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আনে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, অতিমূল্যায়িত মুদ্রা ধরে রাখার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আর্জেন্টিনা বা জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলো দীর্ঘ সময় মুদ্রার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল, যার ফলে তীব্র অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। অপরদিকে, ভিয়েতনাম বা চীনের মতো দেশগুলো সচেতনভাবে মুদ্রাকে কিছুটা অবমূল্যায়িত রেখেছিল, যাতে রপ্তানি খাত প্রতিযোগিতায় শক্তিশালী থাকে।
কোনো দেশের মুদ্রার অতিমূল্যায়ন সাময়িকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বা আমদানি খরচ কমাতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের শিল্প, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ও কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর। তাই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে বাস্তব অর্থনৈতিক শক্তি ও বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রার মান নির্ধারণ করাই উত্তম।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















