গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন মহাসড়ক। এর শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় “উত্তরাপথ” নামে পরিচিত প্রাচীন সড়কে, যা মৌর্য যুগে পাটলিপুত্র থেকে তক্ষশিলা পর্যন্ত প্রধান সামরিক ও বাণিজ্যিক রুট ছিল। গুপ্ত ও পরবর্তী রাজত্বে এই পথ রাজদূত, সাধু, পণ্ডিত, কুম্ভকার, বয়নশিল্পী এবং লবণ, লোহা, তুলা, শস্যের বহরের চলাচলে প্রাণ পায়। হিন্দুকুশের গিরিপথ থেকে গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা পর্যন্ত বহু ভাষা, মুদ্রা ও রীতিনীতি এই পথে মিশেছে।
সুলতানি ও মুঘল যুগের পুনর্গঠন
দিল্লি সুলতানি আমলে যোগাযোগ বাড়লেও, শের শাহ সূরি ১৫৪০–১৫৪৫ সালে সড়কটিকে নতুন রূপ দেন। তাঁর উদ্যোগে সোনারগাঁও থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত পথ সোজা ও প্রশস্ত হয়; প্রতি কোসে সারাই, কূপ, ছায়াগাছ ও মাইলদণ্ড স্থাপিত হয়; ডাকব্যবস্থার জন্য ঘোড়সওয়ার দূত পাঠানো হতো। মুঘলরা এই অবকাঠামো ধরে ডাকবাহক, রাজস্ব সংগ্রহ ও সেনা চলাচলকে মান্যতা দিয়ে কোস মিনার স্থাপন করে; আকবর ও জাহাঙ্গীরের কালে পোস্ট রুট, বাজার ও নদীপাড়ের ঘাটঘাটে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় হয়। ফলে পানিপথ, আগ্রা, আল্লাহাবাদ, বারাণসী, পাটনা, রাজমহল হয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে।

ঔপনিবেশিক আধুনিকীকরণ
উনিশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ সরকার সড়কটিকে পাকা, সেতু–কালভার্টসমৃদ্ধ ও চার ঋতু চলনযোগ্য করে। তখন “গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড” নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়; কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত টোল, থানাঘর, রেস্ট হাউস, ইঞ্জিনিয়ারিং জরিপ, মানচিত্র প্রণয়ন এবং রেল–স্টিমার–ডাকঘোড়ার সঙ্গে আন্তঃমাধ্যম সংযোগ গড়ে ওঠে। নীল, পাট, শস্য ও আফগান ঘি–শুকনো ফলের বাণিজ্য, সৈন্য ও শরণার্থীর চলাচল, এবং বিচার–কর–প্রশাসনের মানকরণে এই সড়ক কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেয়। উনিশ ও বিংশ শতকের সাহিত্য, ভ্রমণবৃত্তান্ত ও গেজেটিয়ারেও এর দীর্ঘপথের গল্প লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও জনজীবন
সড়কটি শুধু পণ্য পরিবহনের রুট নয়; এটি ছিল ধারণা, সুর, খাদ্যরীতি ও কারুশিল্পের সেতু। পারস্যি–তুর্কি প্রভাবিত ভাষা ও পোশাক, উত্তর ভারতীয় কাবাব, বিহারি লিট্টি, বাংলার মসলার সুবাস, পশতুন কাবুলিওয়ালার শুকনো খেজুর—সবই এই পথে ঘুরে ঘুরে জায়গায় জায়গায় স্থায়ী হয়। কারাভানসরাই ঘিরে বাজার, মন্দির–মসজিদ–সরাই মসজিদ, মেলা ও তীর্থের রুটিন গড়ে ওঠে; ডাকপিয়নের ঘণ্টা ও সরাইয়ে রাতযাপনের স্মৃতি আজও লোককথায় আছে।
স্বাধীনতার পর ও বর্তমান গুরুত্ব

১৯৪৭–এর পর সীমান্ত বিভাজনে সড়কটি ভারত, পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ–পাকিস্তান–ভারতের পৃথক অংশে ভাগ হয়। তবু জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক, সীমান্তবন্দর, স্থলপথ বাণিজ্য ও পর্যটনে এর ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। দিল্লি–কলকাতা শিল্প করিডর, বেনাপোল–পেট্রাপোল, আটারি–ওয়াঘা, খাইবার–তোর্খাম প্রভৃতি গেটওয়ে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে চালিত করে; বহু স্থানে প্রাচীন কোস মিনার, পুরোনো সারাই বা বৃক্ষশ্রেণী ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে।
নকশা, প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনা
শের শাহের যুগে সড়কের উভয় পাশে ছায়াগাছের সারি, নির্দিষ্ট কোস অন্তর সারাই ও কূপ, এবং ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতায় সেতু–ঘাটের পরিকল্পনা ছিল সুশৃঙ্খল। ব্রিটিশরা সার্ভে, লেভেলিং, ম্যাকাডাম পদ্ধতির পিচঢালা, ড্রেনেজ, কালভার্ট ও বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে এমব্যাঙ্কমেন্ট নির্মাণে জোর দেয়। প্রহরা, টহল ও টোলব্যবস্থার মাধ্যমে রাস্তার নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ ও রাজস্ব সংগ্রহকে একটি একীভূত প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে আনা হয়।
সমকালীন চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আজকের দিনে যানবাহনের চাপ, নগর বিস্তার, পরিবেশ ক্ষয়, ঐতিহ্য রক্ষার সীমাবদ্ধতা ও সীমান্ত–রাজনীতির জটিলতা পথের ধারাবাহিকতাকে চাপের মুখে ফেলছে। তবু আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, মাল্টিমডাল লজিস্টিক্স, ই–কমার্স, পর্যটন করিডর ও সীমান্তবন্দর উন্নয়ন এই ঐতিহাসিক রুটকে নতুন প্রাণ দিচ্ছে। সংরক্ষিত কোস মিনার, পুরোনো সারাই, এবং স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন জনপরিসর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথের ইতিহাস জানাতে পারে এবং অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















