০৫:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
লেবাননের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ নিহত, নতুন সহিংসতার আশঙ্কা ‘আমার কোনও দোষ ছিল না, কিন্তু আমাকে সব কিছু হারাতে হয়েছে’ ‘সুইম শেডি’ নাম নিয়ে আইনি লড়াইয়ে এমিনেম দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের উপকূলীয় শহর ওওইতায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, পুড়ল শতাধিক ঘর বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুতে এগোচ্ছে জাপান গ্রাহকদের ভোগান্তি কমছে না, এবার রবির বিরুদ্ধে অভিযোগ — জিপি ও বাংলালিংকের আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ইশতেহারে শিশু নিরাপত্তা জোরদারের প্রতিশ্রুতি ভারতের স্পষ্ট বার্তা: যেখানেই হোক, সন্ত্রাস দমনে অভিযান চালানোর পূর্ণ অধিকার আছে ইভি আর স্মার্ট গ্যাজেটের জোরে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা দেখাল শাওমি ভারতের রেড ফোর্ট হামলার উদ্ধার হওয়া ভিডিও: আত্মঘাতী হামলার সাফাই দিচ্ছিলেন উমর উন-নবী

হুলক গিবন: বাংলাদেশের বনজঙ্গলে এক বিস্ময়কর প্রাণী

হুলক গিবন (Hoolock Gibbon) দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র এপ বা বনমানুষ, যা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায়। মানুষের নিকটাত্মীয় এ প্রাণীটি তার দীর্ঘ হাত, দোল খাওয়ার অনন্য ভঙ্গি এবং সুরেলা ডাকের জন্য সুপরিচিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় স্তন্যপায়ীদের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

শারীরিক গঠন

হুলক গিবনের দেহ ছোট হলেও হাত দীর্ঘ এবং শক্তিশালী, যা তাকে সহজে এক ডাল থেকে অন্য ডালে দোল খেতে সাহায্য করে।

  • গড় উচ্চতা: প্রায় ৬০–৯০ সেন্টিমিটার
  • ওজন: ৬–৯ কিলোগ্রাম
  • রঙ: পুরুষ সাধারণত কালো বর্ণের,আর স্ত্রী বাদামি-হালকা রঙের।
    তাদের মুখে সাদা দাগ এবং চোখের চারপাশে স্পষ্ট রঙের ছাপ থাকে।

আবাসস্থল

হুলক গিবন মূলত পাহাড়ি চিরসবুজ বনভূমি ও বাঁশঝাড়ে বসবাস করে।
বাংলাদেশে প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে এর দেখা মেলে। তারা উঁচু গাছে বসবাস করে এবং খুব কমই মাটিতে নামে।

খাদ্যাভ্যাস

তাদের প্রধান খাদ্য ফলমূল, বিশেষ করে পাকা ফল, বীজ, ফুল ও কচি পাতা। মাঝে মাঝে তারা পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে।
হুলক গিবন খাদ্য সংগ্রহের জন্য গাছের মগডাল থেকে মগডালে লাফিয়ে চলে, যা তাকে এক অনন্য দক্ষ আরোহী করে তুলেছে।

সামাজিক জীবন

হুলক গিবন একগামী বা monogamous প্রাণী—একটি জুটি সারাজীবন একসঙ্গে বসবাস করে।
প্রতিটি পরিবারে সাধারণত মা-বাবা এবং তাদের সন্তান থাকে।
তারা নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে প্রতিদিন সকালে সুরেলা ডাক দেয়। এ ডাক অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়, যা তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচয়।

প্রজনন

স্ত্রী হুলক গিবন সাধারণত ৭–৮ বছরে প্রজননক্ষম হয়।
গর্ভধারণকাল প্রায় ৭ মাস, এবং সাধারণত একটি বাচ্চা জন্ম দেয়।
ছানারা দীর্ঘ সময় মায়ের সাথে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্বাধীন হতে শেখে।

আচরণ ও চলাফেরা

হুলক গিবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো “ব্র্যাকিয়েশন”—হাতের ভর করে দোল খেয়ে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যাওয়া।
এরা দিনে সক্রিয় থাকে এবং রাতে গাছের মগডালে ঘুমায়।
তাদের ডাক কেবল এলাকা রক্ষার জন্য নয়, বরং সঙ্গীকে কাছে টানারও মাধ্যম।

সংরক্ষণ অবস্থা

হুলক গিবন বর্তমানে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) অনুযায়ী অতিমাত্রায় বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
বাংলাদেশে বন ধ্বংস, কৃষিজমি সম্প্রসারণ, পাহাড় কাটা, এবং অবৈধ শিকার তাদের অস্তিত্বকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে।
একসময়ে হাজার হাজার হুলক গিবন ছিল, কিন্তু বর্তমানে সংখ্যায় কয়েকশ’তে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি

বাংলাদেশে প্রধানত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকার কিছু অংশে হুলক গিবন টিকে আছে।
তবে তাদের আবাসভূমি ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
বনভূমি সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া এ প্রাণীকে রক্ষা করা কঠিন।

গুরুত্ব

হুলক গিবন শুধু বনজীববৈচিত্র্যের অংশ নয়, বরং বন পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা বীজ ছড়িয়ে দিয়ে বনের গাছপালা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
এছাড়া এ প্রাণী বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের একটি প্রতীক।

হুলক গিবন দক্ষিণ এশিয়ার এক অনন্য প্রাণী, যার অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে।
বাংলাদেশে এ প্রাণী রক্ষায় সরকার, গবেষক, পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
কারণ হুলক গিবন রক্ষা করা মানে শুধু একটি প্রজাতিকে বাঁচানো নয়, বরং আমাদের অরণ্য, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।

জনপ্রিয় সংবাদ

লেবাননের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ নিহত, নতুন সহিংসতার আশঙ্কা

হুলক গিবন: বাংলাদেশের বনজঙ্গলে এক বিস্ময়কর প্রাণী

০৪:০০:১৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫

হুলক গিবন (Hoolock Gibbon) দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র এপ বা বনমানুষ, যা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায়। মানুষের নিকটাত্মীয় এ প্রাণীটি তার দীর্ঘ হাত, দোল খাওয়ার অনন্য ভঙ্গি এবং সুরেলা ডাকের জন্য সুপরিচিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় স্তন্যপায়ীদের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

শারীরিক গঠন

হুলক গিবনের দেহ ছোট হলেও হাত দীর্ঘ এবং শক্তিশালী, যা তাকে সহজে এক ডাল থেকে অন্য ডালে দোল খেতে সাহায্য করে।

  • গড় উচ্চতা: প্রায় ৬০–৯০ সেন্টিমিটার
  • ওজন: ৬–৯ কিলোগ্রাম
  • রঙ: পুরুষ সাধারণত কালো বর্ণের,আর স্ত্রী বাদামি-হালকা রঙের।
    তাদের মুখে সাদা দাগ এবং চোখের চারপাশে স্পষ্ট রঙের ছাপ থাকে।

আবাসস্থল

হুলক গিবন মূলত পাহাড়ি চিরসবুজ বনভূমি ও বাঁশঝাড়ে বসবাস করে।
বাংলাদেশে প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে এর দেখা মেলে। তারা উঁচু গাছে বসবাস করে এবং খুব কমই মাটিতে নামে।

খাদ্যাভ্যাস

তাদের প্রধান খাদ্য ফলমূল, বিশেষ করে পাকা ফল, বীজ, ফুল ও কচি পাতা। মাঝে মাঝে তারা পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে।
হুলক গিবন খাদ্য সংগ্রহের জন্য গাছের মগডাল থেকে মগডালে লাফিয়ে চলে, যা তাকে এক অনন্য দক্ষ আরোহী করে তুলেছে।

সামাজিক জীবন

হুলক গিবন একগামী বা monogamous প্রাণী—একটি জুটি সারাজীবন একসঙ্গে বসবাস করে।
প্রতিটি পরিবারে সাধারণত মা-বাবা এবং তাদের সন্তান থাকে।
তারা নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে প্রতিদিন সকালে সুরেলা ডাক দেয়। এ ডাক অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়, যা তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচয়।

প্রজনন

স্ত্রী হুলক গিবন সাধারণত ৭–৮ বছরে প্রজননক্ষম হয়।
গর্ভধারণকাল প্রায় ৭ মাস, এবং সাধারণত একটি বাচ্চা জন্ম দেয়।
ছানারা দীর্ঘ সময় মায়ের সাথে থাকে এবং ধীরে ধীরে স্বাধীন হতে শেখে।

আচরণ ও চলাফেরা

হুলক গিবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো “ব্র্যাকিয়েশন”—হাতের ভর করে দোল খেয়ে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যাওয়া।
এরা দিনে সক্রিয় থাকে এবং রাতে গাছের মগডালে ঘুমায়।
তাদের ডাক কেবল এলাকা রক্ষার জন্য নয়, বরং সঙ্গীকে কাছে টানারও মাধ্যম।

সংরক্ষণ অবস্থা

হুলক গিবন বর্তমানে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) অনুযায়ী অতিমাত্রায় বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
বাংলাদেশে বন ধ্বংস, কৃষিজমি সম্প্রসারণ, পাহাড় কাটা, এবং অবৈধ শিকার তাদের অস্তিত্বকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে।
একসময়ে হাজার হাজার হুলক গিবন ছিল, কিন্তু বর্তমানে সংখ্যায় কয়েকশ’তে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি

বাংলাদেশে প্রধানত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকার কিছু অংশে হুলক গিবন টিকে আছে।
তবে তাদের আবাসভূমি ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
বনভূমি সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া এ প্রাণীকে রক্ষা করা কঠিন।

গুরুত্ব

হুলক গিবন শুধু বনজীববৈচিত্র্যের অংশ নয়, বরং বন পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা বীজ ছড়িয়ে দিয়ে বনের গাছপালা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
এছাড়া এ প্রাণী বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের একটি প্রতীক।

হুলক গিবন দক্ষিণ এশিয়ার এক অনন্য প্রাণী, যার অস্তিত্ব আজ বিলীন হওয়ার পথে।
বাংলাদেশে এ প্রাণী রক্ষায় সরকার, গবেষক, পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
কারণ হুলক গিবন রক্ষা করা মানে শুধু একটি প্রজাতিকে বাঁচানো নয়, বরং আমাদের অরণ্য, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।