বাংলাদেশ নদীনির্ভর, জলজ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। এখানে দীর্ঘকাল ধরে দেশি প্রজাতির ক্যাটফিশ যেমন—মাগুর, শিং, কই, ট্যাংরা ইত্যাদি মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাইল্যান্ড থেকে আনা থাই ক্যাটফিশ ব্যাপক হারে চাষ হচ্ছে। এই বিদেশি প্রজাতির বিস্তার আমাদের দেশি মাছের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
থাই ক্যাটফিশের বিস্তার ও প্রভাব
থাই ক্যাটফিশ দ্রুত বর্ধনশীল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি এবং বাজারজাত করাও সহজ। তাই স্বল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় চাষিরা ব্যাপকভাবে এই মাছের খামার গড়ে তুলছে। কিন্তু এর ফলে:
- দেশি প্রজাতির জন্য খাদ্য প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে।
- থাই ক্যাটফিশ বেশি পরিমাণে অক্সিজেন ব্যবহার করে, ফলে দেশি মাছ টিকতে পারছে না।
- প্রজনন সময়ে দেশি মাছের ডিম ও বাচ্চা ধ্বংস করছে।
- একক প্রজাতির আধিপত্যে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

দেশি ক্যাটফিশ প্রজাতির জন্য হুমকি
বাংলাদেশে প্রচুর দেশি ক্যাটফিশ প্রজাতি রয়েছে: মাগুর, শিং, কই, বাইম ইত্যাদি। এদের অস্তিত্ব এখন সংকটে। যদি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে থাই ক্যাটফিশ চাষ চলতে থাকে তবে:
- দেশি মাছের জিনগত বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে।
- স্থানীয় জেলেদের জীবিকা বিপন্ন হবে।
- খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, কারণ দেশি মাছের পুষ্টিগুণ তুলনামূলক বেশি।

থাই ক্যাটফিশ চাষ কি চালু থাকা উচিত?
এটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা কঠিন, কারণ অর্থনৈতিক কারণে অনেক চাষি এর ওপর নির্ভরশীল। তবে এটি নিয়ন্ত্রিত চাষের আওতায় আনা জরুরি। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে দেশি মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তাই:
- সীমিত এলাকায় থাই ক্যাটফিশ চাষের অনুমতি দেওয়া উচিত।
- খোলা পানিতে বা নদীতে এই মাছ ছাড়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা প্রয়োজন।
- দেশি মাছের চাষে প্রণোদনা বাড়াতে হবে।
দেশি ক্যাটফিশ রক্ষার উপায়
১. প্রজনন কেন্দ্র তৈরি: দেশি ক্যাটফিশের কৃত্রিম প্রজনন ও সংরক্ষণ প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
২. সরকারি নিয়ন্ত্রণ: থাই ক্যাটফিশ চাষ ও বিপণনের ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা উচিত।
৩. জনসচেতনতা: কৃষক ও চাষিদের বোঝাতে হবে দেশি মাছের পুষ্টি ও বাজারমূল্যের গুরুত্ব।
৪. বিকল্প খাদ্য সরবরাহ: খামারে দেশি মাছ চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ও খাদ্যের ব্যবস্থা দিতে হবে।
৫. গবেষণা: দেশি প্রজাতির জিনগত উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়াতে হবে।

মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ মতামত
ময়মনসিংহের এক চাষি জানালেন, “আমরা আগে পুকুরে মাগুর ও শিং চাষ করতাম। কিন্তু এখন থাই ক্যাটফিশ ছাড়া বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায় না। অথচ দেশি মাছের স্বাদ ও চাহিদা অনেক বেশি।”
ঢাকার এক মাছ বিশেষজ্ঞ বললেন, “থাই ক্যাটফিশ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চাষ চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশি শিং-মাগুর প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে দেশি মাছের প্রজনন প্রকল্প বাড়ানো এবং চাষিদের আর্থিক সহায়তা দেয়া এখনই জরুরি।”
স্থানীয় কৃষকরা মনে করেন, দেশি মাছ চাষে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা পেলে তারা আবার দেশি মাছ চাষে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশে থাই ক্যাটফিশ চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলেও এটি পরিবেশ ও দেশি মাছের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তাই অযাচিত বিস্তার রোধ করে, নিয়ন্ত্রিত চাষ চালু রেখে, দেশি ক্যাটফিশ সংরক্ষণ ও চাষে উৎসাহ দিতে হবে। সঠিক নীতি ও সচেতনতা থাকলে দেশি প্রজাতি রক্ষা করা সম্ভব এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশের ভারসাম্য অক্ষুণ্ণ রাখা যাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















