ভদ্রা নদী খুলনা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর মধ্যে অন্যতম। এর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১৯৩ কিলোমিটার। নদীটির প্রধান উৎস হলো কপোতাক্ষ নদী, যা ঝিনাইগাছা উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভদ্রা নদীতে পরিণত হয়। এরপর ভদ্রা নদী খুলনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে নেমে গিয়ে পশ্চিম বাংলায় শিবসা ও পশুর নদীর সংযোগস্থলে বিলীন হয়ে যায়। এই অংশটিকে স্থানীয়ভাবে ‘মরা ভদ্রা’ হিসেবে ডাকা হয়।
দুই তীরের সভ্যতা ও মানবজীবন
ভদ্রা নদীর দুই তীরে শতাব্দী ধরে গ্রামের জীবন, কৃষি, চিংড়ি-বাগান, খাল-কাঠুরে ও ছোট ছোট মৎস্যখামার গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় নদীর তীরে বসবাসকারীরা চারা খামারি, আমন-আলু চাষ এবং চিংড়ি পালন করে জীবন কাটান।
সুন্দরবনের কাছাকাছি এ অঞ্চল কৃষিজীবনের পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ বন ও নদীর ইকোসিস্টেমের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। নদীর স্বচ্ছ জল, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই জীবনকে আরও গভীর করে তোলে।

জল সম্পদ ও পরিবেশ
ভদ্রা নদী তাজা ও লবণাক্ত জলের একটি মিশ্র প্রবাহ—এটি তাজা পানির উৎস হিসেবে কৃষি ও পানীয় জলের প্রয়োজন মেটায়। প্লাবন ও জলের সাঁতরে সৃষ্ট মাটির উর্বরতা কৃষিজমিকে উর্বর করেছে। চিংড়ি খামার, মাছ চাষ এবং ছোট স্তরের জলবায়ুগত সঞ্চালন এই নদীর অক্লান্ত অবদান। তবে, নদী ও সুন্দরবনের নড়বড়ে ক্রমবর্ধমান ক্ষতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ পরিবেশ ও মানুষের জীবনপ্রবাহে হুমকি তৈরি করেছে।
নদী ও বাঁধ: ক্ষতির পরিমাণ
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে জানা যায়, ভদ্রা নদীর পোল্ডার ২২-এর তীরের বাঁধ ভেঙে প্রায় ৩০ মিটার ধসে গেছে। এছাড়া ঝড় “রেমাল”-এ কিছু স্থানে বাঁধের ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশ ধ্বংস হয়েছে, ৩৫টি স্থানে মাটি ভাঙন হয়েছে এবং ২২টি জায়গায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সংক্ষেপে, বিভিন্ন বাঁধের (পোল্ডার) স্থানে নদীর ক্ষয় ও ঝড়ের কারণে হাজার হাজার হেক্টর চাষের জমি প্লাবিত, কৃষক ও মাছ চাষীর বিপুল ক্ষতি হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভদ্রা নদী ও চালনা পোর্টের সম্পর্ক
ব্রিটিশ শাসনকালে (১৭৫৭–১৯৪৭), সুন্দরবনের বন সংরক্ষণের পাশাপাশি নদ-নদীর নেটওয়ার্কের মানচিত্র করা হয়েছিল। সুন্দরবনের প্রথম বন ব্যবস্থাপনা বিভাগ ১৮৬৯ সালে খুলনার হেডকোয়ার্টার্স থেকে চালু হয়েছিল, এবং ১৮৭৫ ও ১৮৭৬ সালে অনেক বন এলাকা সংরক্ষিত ঘোষিত হয়। ভদ্রা নদী, পশুর নদী ও শিবসার সাথে যুক্ত হয়ে নদীপথে চালনা পোর্ট পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল বলে অনুমান করা যায়। যদিও সরাসরি ব্রিটিশ রেকর্ডে “ভদ্রা–চালনা লিঙ্ক” একটু অস্পষ্ট, তার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নদীর মাধ্যমে পণ্যবাহী নৌযান চালনা যেত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। বর্তমান দিনে সেই পুরনো নেটওয়ার্কের কিছু অংশ অদৃশ্য হয়েছে বা হারিয়ে গেছে; যেমন “মরা ভদ্রা” হিসেবেই উল্লেখ।
ভদ্রা নদী শুধু একটি জলপথ নয়; এটি খুলনা–সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জীবন, কৃষিকাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতির প্রাণসঞ্চার। নদীর দুই তীরের নানা জনগোষ্ঠীর আদি সভ্যতা, নদী-ভিত্তিক কাজের নির্ভরতা, এবং উন্নয়ন ও বন্যার সংকট—allই ভদ্রাকে একটি জীবন্ত উপাদান করে তোলে। বাঁধের প্রবল ক্ষয় এই ভদ্রার প্রবাহে বিপর্যয়ের কারণ, মেরামতের ত্বরিত ব্যবস্থা ও পরিকল্পনামূলক পদক্ষেপ শুধুই নয়—সামগ্রিকভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও সংবলিত পরিবেশের পুনর্গঠন প্রয়োজন।
এই ভাবনার আলোকে আশা করি, স্থানীয়, ইতিহাসবিদ ও পরিকল্পনাকারীরা ভদ্রা নদীর প্রতি আরও দৃষ্টিপাত করবেন এবং এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সংরক্ষণে কাজ করবেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















