বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আর্সেনিক চোখে দেখা যায় না, স্বাদ বা গন্ধেও বোঝা যায় না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বিষাক্ত উপাদান শরীরে প্রবেশ করলে এটি নীরব ঘাতকের মতো কাজ করে। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বছরের পর বছর আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পান করছে, যার ফলে তারা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
আর্সেনিক কীভাবে শরীরে ক্ষতি করে
আর্সেনিক একটি ধাতব উপাদান যা পানির মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। পান করার পাশাপাশি রান্নার কাজে আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহার করলেও শরীর আক্রান্ত হয়। একবার রক্তে মিশে গেলে এটি যকৃত, ফুসফুস, কিডনি ও ত্বকে জমা হতে থাকে। দেহের কোষে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে আর্সেনিক কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ধীরে ধীরে নানা ধরনের জটিল রোগ দেখা দেয়।
আর্সেনিক থেকে সৃষ্ট রোগ
আর্সেনিকের প্রভাবে অনেক ধরনের রোগ সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে আগে দেখা যায় ত্বকের পরিবর্তন—ত্বকে কালো দাগ, চুলকানি ও অস্বাভাবিক ক্ষত। দীর্ঘদিন এ অবস্থায় থাকলে তা চর্ম ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। এছাড়া আর্সেনিক ফুসফুসের ক্যান্সার, মূত্রথলি ও লিভারে ক্যান্সার ঘটাতে পারে।

এটি শুধু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় না। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগও তৈরি করে। লিভার ও কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, ফলে শরীর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্নায়বিক সমস্যা যেমন হাত-পায়ের অসাড়তা, মাথাব্যথা, অবসাদও তৈরি হয়। গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে আর্সেনিক গর্ভপাত ও নবজাতকের জন্মগত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি আর্সেনিক গ্রহণ করলে প্রায় ২০–২৫ ধরনের জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে আর্সেনিকের বিস্তার
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম আর্সেনিক-প্রবণ দেশ। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা সীমার বাইরে চলে গেছে বহু জেলায়। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে প্রায় ৬০ জেলাতেই কোনো না কোনো মাত্রায় আর্সেনিক দূষণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুর, মাদারীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
বিশেষ করে চাঁদপুর জেলায় আর্সেনিক দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, তাই এটিকে আর্সেনিক দূষণের ‘কেন্দ্রবিন্দু’ বলা হয়। ধারণা করা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। এর ফলে তারা প্রতিদিন ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

করণীয়
আর্সেনিক সমস্যা মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো নিরাপদ পানির উৎস নিশ্চিত করা। গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করলে সাধারণত আর্সেনিক পাওয়া যায় না। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করাও একটি কার্যকর সমাধান। এছাড়া বাজারে পাওয়া আর্সেনিক ফিল্টার ব্যবহার করে নলকূপের পানি পরিশোধন করা যায়।
শুধু প্রযুক্তিগত সমাধানই যথেষ্ট নয়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণা, গণসচেতনতা কর্মসূচি এবং স্কুল-কলেজে শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই মানুষ বুঝতে পারবে আর্সেনিক কতটা ভয়াবহ এবং কিভাবে এ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা
ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, “আর্সেনিক-জনিত রোগগুলো ধীরে ধীরে দেখা দেয়। রোগী প্রথমে বোঝে না, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে ত্বকের ক্ষত ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষতি মারাত্মক আকার নেয়।” তিনি সতর্ক করে বলেন, আর্সেনিক-জনিত ক্যান্সার বাংলাদেশে বাড়ছে এবং এটি ভবিষ্যতে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

চাঁদপুর জেলার এক স্থানীয় কৃষক জানিয়েছেন, “আমাদের গ্রামের অনেকেই হাত-পায়ে দাগ নিয়ে ভুগছেন। ডাক্তার বলেছে এটা আর্সেনিকের কারণে হয়েছে। আমরা এখন গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করি, কিন্তু অনেকেই এখনো পুরোনো নলকূপের পানি খাচ্ছেন।” এই বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে আর্সেনিক কেবল বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর্সেনিক ধীরে ধীরে মানুষের শরীরকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়। এটি শুধু ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না, বরং পরিবার, সমাজ এবং গোটা জাতির জন্য এক ভয়াবহ হুমকি। একে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে আর্সেনিকজনিত রোগ মহামারীতে রূপ নিতে পারে। তাই এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিরাপদ পানি সরবরাহ, বিকল্প উৎস ব্যবহার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশ এই নীরব ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















