বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা কিংবা যমুনার মতো বৃহৎ নদীগুলো আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ হলেও বরিশাল ও ঝালকাঠির মানুষ চিরকাল মনে রেখেছে অপেক্ষাকৃত ছোট অথচ অনন্য এক নদীকে—সুগন্ধা নদী। মাত্র ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীই গড়ে তুলেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি। দুই শতাধিক বছরের ইতিহাসে নদীটি একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের প্রাণশক্তি, অন্যদিকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও স্থানীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু।
আজ যখন বাংলাদেশ জুড়ে নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে, দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, তখন সুগন্ধা নদীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গুরুত্ব নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
উৎপত্তি ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
সুগন্ধা নদী মূলত বরিশালের কীর্তনখোলা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে ঝালকাঠির দপদপিয়া অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। এরপর এটি নলছিটি, কুলকাঠি, পোনাবলিয়া হয়ে গাবখান ধানসিঁড়ির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশখালী নদীতে গিয়ে মেশে। এভাবে সুগন্ধা নদী দক্ষিণাঞ্চলের বহু ছোট বড় নৌপথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
নদীর গড় প্রস্থ প্রায় ৪০০ মিটার। বর্ষাকালে নদীর পানি প্রবাহিত হয় ভয়াবহ শক্তি নিয়ে, অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমেও নদীটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় না। এ বৈশিষ্ট্যই একে বরিশাল অঞ্চলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য নৌপথে পরিণত করেছে।

নামকরণের পুরাণ ও লোককথা
সুগন্ধা নদীর নামকে ঘিরে প্রচলিত আছে নানা লোককথা। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, হিন্দু পুরাণে দেবী উগ্রতারার নাসিকা এখানে পতিত হয়েছিল। সেই থেকে এ স্থান দেবীপীঠে পরিণত হয় এবং নদীর নামকরণ হয় “সুগন্ধা”—অর্থাৎ সুগন্ধ ছড়ানো নদী।
গ্রামীণ লোককথায় আরও আছে, একসময়ে নদীর দুই তীরে সুগন্ধি ফুলের বন ছিল। সেখান থেকে ভেসে আসা সুগন্ধে মানুষ নদীর নাম দিয়েছে ‘সুগন্ধা’। যদিও এই কাহিনির ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, তবে লোকবিশ্বাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব: ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান ধারা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ইতিহাসে সুগন্ধা নদী অন্যতম প্রধান সেতুবন্ধন। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকেই এ নদী ব্যবহার করে কৃষিজ ফসল, পাট, চাল-ডাল, শাকসবজি এমনকি কাঠ ও মাটির পণ্যও পরিবহন করা হতো।
স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, ঝালকাঠির কাঠ ব্যবসা এবং বরিশালের ধান বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই নদী। নদীপথে সহজ যোগাযোগের কারণে নলছিটি ও ঝালকাঠি এলাকায় ভাসমান বাজারের জন্ম হয়। আজও সুগন্ধার দুই তীরে ছোট-বড় ভাসমান বাজার বসে, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিনিময় ও বিক্রয় চলে।
কৃষিজ অর্থনীতি ও নদীর অবদান
সুগন্ধা নদী শুধু যোগাযোগই নয়, কৃষিরও প্রধান সহায়ক। নদীর বন্যার পানি তীরবর্তী জমিগুলোকে উর্বর করে তোলে। এই অঞ্চলে ধান, পাট, শাকসবজি এবং ফলের বাগান বিশেষভাবে সফল হয়েছে নদীর পানি ও উর্বর মাটির কারণে।
বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা বলেন—“নদী যদি বাঁচে, কৃষি বাঁচে।” তাই নদীটির প্রতি তাদের নির্ভরতা একেবারে সরাসরি। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি দিয়ে সেচ দেওয়া হয়, আর বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ধানের জমি ভরিয়ে দেয়।

মৎস্য সম্পদ ও জীবিকা
সুগন্ধা নদী একসময়ে ইলিশসহ নানা মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাত ছিল। স্থানীয় জেলেরা বলতেন, এক রাতে নৌকাভর্তি ইলিশ পাওয়া যেত এই নদী থেকে। শুধু ইলিশ নয়, শোল, বোয়াল, রুই, কাতলা, আইড় ইত্যাদি মাছও প্রচুর পরিমাণে ধরা হতো।
কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত মাছ ধরা, বিষ প্রয়োগ ও নদীর ভাঙনের কারণে মাছের প্রাচুর্য কমে গেছে। তারপরও বহু পরিবার মাছ ধরা ও বিক্রির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
নৌপরিবহন ও যাত্রী সেবা
সুগন্ধা নদী বরিশাল অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল ভরসা। ছোট ট্রলার, লঞ্চ, ফেরি ও দেশীয় নৌকা নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী ও ব্যবসায়ী এই নৌপথে যাতায়াত করেন।
নদীর গুরুত্ব শুধু অভ্যন্তরীণ যাত্রায় নয়; বিশখালী হয়ে এটি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে পণ্য পরিবহনেও নদীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝালকাঠি ও নলছিটির বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল পরিবহনে এখনো এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।
বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ
অতীতে সুগন্ধা নদীর দুই তীরে ঘন বনাঞ্চল বিস্তৃত ছিল। স্থানীয়রা বলতেন, দিনের বেলাতেও সেই জঙ্গলে প্রবেশ করতে ভয় লাগতো। সেখান থেকে ভেসে আসা লোককথার মধ্যে আছে ঢিবি থেকে মূর্তি আবিষ্কার, প্রাচীন মন্দির প্রতিষ্ঠা, দেবীর পূজা ইত্যাদি।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। নদীর তীরবর্তী বনাঞ্চল ক্রমেই কমে গেছে। অতিরিক্ত জনবসতি, কৃষিজমির সম্প্রসারণ, কাঠ সংগ্রহ এবং নদী ভাঙনের কারণে সেই ঘন জঙ্গল আর নেই। এর ফলে জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

ধর্মীয় তাৎপর্য: শক্তিপীঠ সুগন্ধা
ঝালকাঠির শিকারপুরে অবস্থিত সুগন্ধা শক্তিপীঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এক অনন্য পুণ্যস্থান। পুরাণ মতে, দেবী উগ্রতারার নাসিকা এখানে পতিত হয়েছিল। এখানেই দেবী ‘সুনন্দা’ এবং ভৈরব ‘ত্র্যম্বকেশ্বর’ পূজিত হন।
প্রতি বছর শিবচতুর্দশী উৎসবে হাজার হাজার ভক্ত নদীপথ পেরিয়ে এই মন্দিরে আসেন। এর ফলে ধর্মীয় উৎসব যেমন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তেমনি স্থানীয় অর্থনীতিতেও নতুন গতি আনে। ভক্তদের জন্য নৌপরিবহন, বাজার, আশ্রয় ও ব্যবসা—সব মিলিয়ে নদীর ধর্মীয় তাৎপর্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িয়ে গেছে।
নদীসংলগ্ন সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন
সুগন্ধা নদীর দুই তীরে বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রা নদীকেন্দ্রিক। ভোরবেলা মাছ ধরা, দুপুরে নৌকায় বাজারে যাওয়া, সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে আড্ডা—এসবই গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভাসমান বাজার শুধু বাণিজ্যের স্থান নয়; এটি এক সামাজিক মেলবন্ধনেরও কেন্দ্র। বরিশালের লোকগান, নৌকাবাইচ, গ্রামীণ মেলা—সবকিছুতেই নদীর উপস্থিতি অপরিহার্য।

জলসম্পদ ও নৌপথের গুরুত্ব
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সুগন্ধাকে প্রথম শ্রেণির নৌপথ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কারণ এটি সারা বছর প্রবাহমান থাকে।
বরিশাল ও ঝালকাঠির মধ্যে মালবাহী নৌযান প্রতিদিন চলাচল করে। পণ্য পরিবহনে খরচ কম হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এখনও নদীপথকে সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মনে করেন।
বর্তমান সংকট ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে নদীটি নাব্যতা সংকটে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর কমে যায়, যার ফলে ফেরি ও বড় নৌযান চলাচল ব্যাহত হয়। দখল ও দূষণও এখন বড় সমস্যা। নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবছরই দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়—জাহাজ বিস্ফোরণ, ফেরিতে আগুন, নৌকাডুবি ইত্যাদি। এসব দুর্ঘটনা মানুষের জীবন ও সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি
অতীতে যে নদীতে ইলিশের সমারোহ ছিল, এখন সেখানে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত জাল ফেলা, অপরিকল্পিত বাঁধ, এবং শিল্পবর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
একই সঙ্গে নদী ভাঙনের কারণে কৃষিজমি হারাচ্ছে মানুষ। এতে স্থানীয় অর্থনীতি ও মানুষের জীবিকা দুটোই সংকটে পড়ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সংরক্ষণ উদ্যোগ
সুগন্ধা নদীকে বাঁচাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যেই নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং প্রকল্প নিয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ দখল উচ্ছেদ, দূষণ রোধ ও বনাঞ্চল পুনরুদ্ধারের উদ্যোগও নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুগন্ধাকে কেন্দ্র করে পরিবেশবান্ধব পর্যটন গড়ে তোলা সম্ভব। ভাসমান বাজার, ধর্মীয় শক্তিপীঠ, নৌকাবাইচ—এসবকে মিলিয়ে নদীকে এক বিশেষ পর্যটন গন্তব্যে রূপ দেওয়া যায়।
উপসংহার
সুগন্ধা নদী কেবল একটি নদী নয়; বরং বরিশাল ও ঝালকাঠির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, কৃষি ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। দুই শতাধিক বছর ধরে এটি মানুষের জীবনচক্রকে গড়ে তুলেছে।
আজ নাব্যতা সংকট, দখল, দূষণ ও পরিবেশ ধ্বংসের মুখে দাঁড়ালেও নদীটির গুরুত্ব কমেনি। বরং এখনই সময় সম্মিলিত উদ্যোগে এই নদীকে রক্ষা করার।
সুগন্ধা বাঁচলে শুধু একটি নদীই টিকে থাকবে না, বরং টিকে থাকবে বরিশালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানুষের জীবনের সুগন্ধ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















