পরিচিতি
প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপ বা Chrysopelea paradisi প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। পৃথিবীতে এমন প্রাণীর সংখ্যা খুব কম যাদের দেখে মনে হয় সাপ হয়েও তারা উড়তে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন বনভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী এই সাপ মানুষের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই রহস্যময়। এর উজ্জ্বল রঙ, সাপের দেহের ভাঁজ এবং বাতাসে গ্লাইড করার ক্ষমতা একে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশেও বিশেষ করে চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসে এর উপস্থিতি রিপোর্ট করা হয়েছে।
বিস্তার ও আবাসস্থল
প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপ মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাওয়া যায়। ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং সিঙ্গাপুর ছাড়াও বাংলাদেশের বনাঞ্চলেও এর অস্তিত্ব রয়েছে। আমাদের দেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও সিলেট অঞ্চলের কিছু বনভূমিতে এর দেখা মেলে। এরা সাধারণত গাছপালা-ঘেরা আর্দ্র পরিবেশ পছন্দ করে। নারকেল বাগান, পাহাড়ি বন কিংবা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকায় এদের বেশি দেখা যায়।

শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য
প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৬০ সেন্টিমিটার থেকে ১.২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেহের রঙ অত্যন্ত আকর্ষণীয়—কালো পৃষ্ঠে সবুজ বা হলুদ বিন্দু ছড়িয়ে থাকে, মাঝে মাঝে লাল বা কমলা রঙের দাগও দেখা যায়। দেহ চ্যাপ্টা ও নমনীয়, যা গ্লাইড করার সময় কাজে লাগে। এদের চোখ উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ, যা গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে পড়ার সময় দূরত্ব নির্ধারণে সহায়ক হয়।
গ্লাইডিং ক্ষমতা: প্রকৃতির বিস্ময়কর কৌশল
এই সাপের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো আকাশে গ্লাইড করার ক্ষমতা। গাছের শাখা থেকে ঝুলে পড়ে এরা দেহকে চ্যাপ্টা করে নেয়। এরপর শরীরকে U-আকৃতিতে বাঁকিয়ে বাতাসে ভেসে যায়। বাতাসে ভেসে চলার সময় তারা শরীর কাঁপিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে এবং প্রায় ১০ থেকে ২০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি দূরত্বেও গ্লাইড করতে দেখা গেছে। এই ক্ষমতার কারণে প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপকে অনেক সময় “প্রকৃতির গ্লাইডার” বলা হয়।
খাদ্যাভ্যাস ও শিকার
প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপ গাছে গাছে ছোট প্রাণী শিকার করে। টিকটিকি, ছোট ব্যাঙ, পাখির বাচ্চা এবং কখনও কখনও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী এদের খাদ্যতালিকায় থাকে। শিকার করার সময় এরা গাছের ডাল থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারকে ধরে ফেলে। এদের দেহে হালকা বিষ আছে যা শিকারকে দ্রুত দুর্বল করে ফেলে, তবে মানুষের জন্য এই বিষ বিপজ্জনক নয়।

প্রজনন ও বংশবিস্তার
প্রজননের মৌসুমে স্ত্রী সাপ ডিম পাড়ে। সাধারণত ৬ থেকে ১২টি ডিম একসঙ্গে দেয়। গাছের গর্ত, শুকনো পাতা কিংবা ঝোপঝাড়ের ভেতর এরা নিরাপদ জায়গায় ডিম ফেলে রাখে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর অল্প বয়স থেকেই তারা গাছে চড়তে সক্ষম হয়। প্রকৃতির সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতা এদের টিকে থাকার প্রধান শক্তি।
চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসে উপস্থিতি
বাংলাদেশে প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপ মূলত চট্টগ্রামের হিল ট্র্যাক্টস অঞ্চলে দেখা যায়। পাহাড়ি অরণ্য, বাঁশঝাড় ও ফলজ বাগান এদের বসবাসের জায়গা। স্থানীয় মানুষদের মতে, এরা মানুষের ক্ষতি করে না, বরং অনেক সময় গাছ থেকে হঠাৎ উড়ে গিয়ে ভয়ের সঞ্চার করে। গ্রামবাসীরা অনেক সময় একে “উড়ন্ত সাপ” নামে ডাকে। স্থানীয় লোককথায় এর উপস্থিতি নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে তা ব্যাখ্যা করা যায়।

স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা
চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসের অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, বর্ষাকালে বা আর্দ্র মৌসুমে এই সাপের দেখা বেশি মেলে। তারা গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায় এবং মাঝে মাঝে আকাশে উড়ে যায়। সাধারণ মানুষ যদিও প্রথমে ভয় পায়, কিন্তু জানে যে এই সাপ প্রাণঘাতী নয়। তাই এদের নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় না, বরং কৌতূহল জন্মায়।
সংরক্ষণ ও গবেষণা
প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপ বর্তমানে বিপন্ন তালিকায় নেই, তবে বনভূমি ধ্বংস হলে এর আবাসস্থল সংকুচিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসের বনাঞ্চল সুরক্ষিত রাখা গেলে এই সাপের বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে। গবেষকরা মনে করেন, এদের গ্লাইডিং কৌশল নিয়ে প্রযুক্তিগত গবেষণা করলে ভবিষ্যতে বিমানবিজ্ঞান ও রোবটিক্সে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
প্যারাডাইস ফ্লাইং সাপ প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘন জঙ্গলে যেমন এরা সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টসেও এদের দেখা পাওয়া আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হয়েও আকাশে ভেসে বেড়ানোর এই সাপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে এদের রহস্যময় জীবন সম্পর্কে আরও জানলে প্রকৃতি ও প্রযুক্তি উভয়ের জন্যই তা মূল্যবান হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















