আসাদের পতনের পর এক ক্ষণস্থায়ী ঐক্য
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় এক মুহূর্তের জন্য হলেও ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছিল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর মানুষ নতুন নেতা আহমেদ আল-শারার পেছনে সমবেত হয়েছিল। যদিও তার ইসলামপন্থি অতীত নিয়ে অনেকের অস্বস্তি ছিল, বেশিরভাগ সিরীয় তাকে সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেই আবহ ম্লান হয়ে গেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন শারার সরকারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ধীরে ধীরে একটি সংগঠিত রাজনৈতিক বিরোধী শক্তির উদ্ভব ঘটছে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দুর্বল সরকারি প্রতিক্রিয়া
বিরোধী স্রোত তৈরির মূল কারণ সাম্প্রদায়িক রক্তপাত। জুলাই মাসে সুয়াইদা প্রদেশে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ড্রুজ সম্প্রদায়ের বাস, সেখানে সরকার-সমর্থিত সুন্নি মিলিশিয়ারা কয়েকশ মানুষকে হত্যা করে। এর আগে মার্চ মাসে উপকূলীয় অঞ্চলে সুন্নি যোদ্ধারা ১,৪০০ জনের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আলাউইত, সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যাদের আসাদের শাসন টিকিয়ে রাখার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
সরকার উভয় ক্ষেত্রেই আস্থাজনক কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। মার্চে তারা হত্যাযজ্ঞ থামাতে দেরি করেছিল, আর জুলাইয়ে সরকারি সেনাদেরই নৃশংসতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মানুষ হতাশ হয়েছে, আর নতুন তদন্ত নিয়েও একই শঙ্কা বিরাজ করছে। সংখ্যালঘুদের কাছে বার্তাটা পরিষ্কার—নতুন সরকার তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে না, তাদের কথা শুনছে না, আর তাদের রক্ষা করতেও অক্ষম বা অনিচ্ছুক।

‘সিরিয়ান সেন্টেনারি ইনিশিয়েটিভ’-এর সূচনা
এই হতাশার মধ্যে জুলাইয়ে কয়েকজন কর্মী মিলে গড়ে তোলেন সিরিয়ান সেন্টেনারি ইনিশিয়েটিভ। এটি শারার সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত রাজনৈতিক বিরোধিতার ইঙ্গিত দেয়। শুরুতেই তারা যুদ্ধবিরতির দাবি তোলে এবং শারার স্বাক্ষরিত সাংবিধানিক ঘোষণার সংস্কার দাবি করে, যাতে রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা ও নাগরিক সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
এই নামকরণ করা হয়েছে এক শতাব্দী আগে ড্রুজদের নেতৃত্বে ফরাসি ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে হওয়া বিদ্রোহের স্মরণে। এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জর্জ সাবরা—যিনি আসাদের আমলে নির্বাসিত বিরোধী জোটের নেতা ছিলেন, ব্রিটিশ-সিরীয় ধনকুবের আইমান আসফারি, আলাউইত কর্মী ও আলেপ্পোর ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, সিরিয়ার ঐক্যের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: উপেক্ষা ও দমন
সরকার এ আন্দোলনকে স্বাগত জানায়নি। দাবিগুলো উপেক্ষা করে বরং সদস্যদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক থেকে অ্যাক্টিভিস্ট হাজেম দাখিল জানান, “আমাদের উদ্যোগকে মূল্যায়ন না করে সরকার অপপ্রচার শুরু করেছে। তারা দাবি করছে আমরা নাকি শারাকে সরিয়ে সামরিক কাউন্সিল বসাতে চাই—যা আমাদের বিবৃতিতে নেই।”

অধিকাংশ নাগরিক সমাজকর্মীর মতে, সমালোচনাকে সরকার দেশদ্রোহিতা হিসেবে বিবেচনা করছে। আলাউইত নারীদের নিখোঁজ হওয়ার খবর মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রকাশ করলেও সরকার তা অস্বীকার করেছে। যারা এসব নিয়ে অনুসন্ধান করছে, তারা অনলাইন ট্রলের আক্রমণ ও গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছে।
ভেঙে পড়া জোট ও সংখ্যালঘুদের অবিশ্বাস
সুয়াইদার হত্যাযজ্ঞের পর ড্রুজ নেতারা নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করেছেন। মার্চের হত্যাকাণ্ড আলাউইতদের গভীর অবিশ্বাসী করে তুলেছে। মিলিশিয়াদের নিয়ে জাতীয় সেনা গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ, উত্তর-পূর্বে কুর্দিদের সঙ্গে আলোচনাও স্থবির। সংখ্যালঘুদের সেনা ও পুলিশে অন্তর্ভুক্ত করা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য জরুরি হলেও শারা তাতে কোনো অগ্রগতি করতে পারেননি।
সংকীর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ
শারার সিদ্ধান্ত গ্রহণ সীমিত কয়েকজন প্রাক্তন বিদ্রোহী সহযোগীর মধ্যে আটকে আছে। তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে কাজ করছে, আর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে আনুগত্য ও পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে, ব্রিটিশ-সিরীয় লেখক রবিন ইয়াসিন-কাসাব বলেন, “তারা মিলিশিয়া সদস্যের মতো চিন্তা করছে। এখন আর ইদলিবে যুদ্ধরত বিদ্রোহী নয়, বরং রাজনৈতিক উপায়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে।”

আন্তর্জাতিক সমর্থন ও ভঙ্গুর আস্থা
কৃতিত্বের জায়গা আছে—শারা যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছেন। উপসাগরীয় দেশ ও তুরস্ক বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তবে সুয়াইদার সহিংসতা বিদেশি মিত্রদের আস্থা নড়বড়ে করেছে। তারা চিরকাল ধৈর্য ধরবে না, বিশেষ করে যদি শারা কেবল সুন্নিদের পক্ষে শাসন চালিয়ে যান।
সাধারণ মানুষের হতাশা
যদিও দৈনন্দিন সহিংসতা কিছুটা কমেছে, তবুও সিরিয়ার প্রতি দশজনের মধ্যে নয়জন এখনো দারিদ্র্যে বসবাস করছে। সংখ্যালঘুরা আগের মতোই বঞ্চিত বোধ করছে। বহু আলাউইত চাকরি হারিয়েছে, কিছু ড্রুজ মিলিশিয়া প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পতাকা উড়াচ্ছে, এমনকি বিচ্ছিন্নতার ডাক দিচ্ছে।
এক আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী সতর্ক করে বলেছেন, “তিনি যত বেশি সংখ্যালঘুদের দূরে ঠেলছেন, তত বেশি কেবল সাম্প্রদায়িক সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















