০৮:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
ট্রাম্পের কৃষিপণ্য শুল্ক ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে পারে ভারতের রপ্তানি ডেঙ্গুতে আরও ৬ জনের মৃত্যু, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৭৮৮ রোগী দিল্লি–ঢাকা অংশীদারত্বে ওষুধ শিল্পের গুরুত্ব সারাদেশে মোবাইল ফোনের দোকান বন্ধের ঘোষণা গাজীপুরে ফিনিক্স কয়েল কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, নিরাপদে সরানো হয়েছে ৫০০ শ্রমিক চার মাসেই বেনাপোল দিয়ে ১৪ হাজার টন দিল্লির চাল এল ঢাকায় বেইজিংয়ের হুঁশিয়ারি: তাইওয়ান নিয়ে মন্তব্য না বদলালে জাপানের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা  দুবাই ইনফ্লুয়েন্সার অনুনয় স্যূদের মৃত্যু: লাস ভেগাস পুলিশের নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করল শেষ কয়েক ঘণ্টার করুণ পরিস্থিতি নতুন বন্যায় ডুবে ভিয়েতনাম, ঝুঁকিতে কফি ফসল ও গ্রামীণ জীবন লেবাননের শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ নিহত, নতুন সহিংসতার আশঙ্কা

বাংলাদেশে বেড়ে চলা দারিদ্র্যের কশাঘাত

২০২২ সালে বাংলাদেশে দরিদ্রতার হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, তা এখন বেড়ে ২৭.৯৩ শতাংশ হয়েছে। অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)৷

সোমবার পিপিআরসি এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস)-এর যৌথ উদ্যোগে ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটিতে এসব তথ্য জানানো হয়। গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। গত মে মাসে আট হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে এ গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দরিদ্রের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। পিপিআরসির গবেষণায় দেখা গেছে, অতি দারিদ্র্যও তিন বছর পর বেড়ে ৯.৩৫ শতাংশ হয়েছে। দারিদ্র্য বেড়ে হয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশ। পিপিআরসি বলছে, এখনো দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার যে-কোনো সময় গরিব হয়ে যেতে পারে।

পারিবারিক আয় কোথায় কেমন
গবেষণা বলছে, শহরে পরিবারের মাসিক আয় কমেছে, তবে খরচ বেড়েছে । শহরের একটি পরিবারের এখন গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। গড়ে খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের একটি পরিবারের এখন গড় আয় ২৯ হাজার ২০৫ টাকা আর গড় খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা।

জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। সঞ্চয় থাকে না বললেই চলে।

সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ১২.২ শতাংশ সপ্তাহে অন্তত এক বেলা না খেয়ে থাকেন। এছাড়া ৯ শতাংশ মানুষ মাসে অন্তত একদিন না খেয়ে থেকেছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার অভাবের কথাও বলা হয়েছে পিপিআরসির গবেষণা প্রতিবেদনে।

সেখানে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিচালিতসামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির১৬.৫ শতাংশ গরিবরা পায় না। এছাড়া যারা গরিব নয়, তবে যে-কোনো সময় গরিব হতে পারে, এমন ২৭. ৫ শতাংশ মানুষ সরকারি বিভিন্ন ভাতা পান। এই দুটি বিষয় মেলালে দেখা যায়, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে ৪৪. ৩০ শতাংশই সঠিক মানুষ পাচ্ছেন না।

খাবারেই বেশি খরচ
একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কিনতে। খাবার কিনতে একটি পরিবার মাসে গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা খরচ করে। এ ছাড়া প্রতি মাসে শিক্ষায় এক হাজার ৮২২ টাকা, চিকিৎসায় এক হাজার ৫৫৬ টাকা, যাতায়াতে এক হাজার ৪৭৮ টাকা ও আবাসনে এক হাজার ৮৯ টাকা খরচ হয়।

চলমান তিন সংকট
পিপিআরসি বলেছে, দেশে এখন তিন ধরনের সংকটের প্রভাব চলমান। এগুলো হলো : কোভিড (২০২০-২০২২), মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। পিপিআরসির মতে , গত বছরের আগস্টের পর ঘুস কমলেও তা বন্ধ হয়নি। গত বছরের আগস্ট মাসের আগে গবেষণায় মতামত প্রদানকারীদের ৮ .৫৪ শতাংশ সেবা নিতে ঘুস দিয়েছেন। আগস্ট মাসের পর এই হার ৩. ৬৯ শতাংশে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি ঘুস দেয়া হয়েছে সরকারি অফিসে। এরপরে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের। তবে কোনো কাজ করতে গিয়ে ঝামেলা এড়াতে বেশি ঘুস দিচ্ছে মানুষ। গত সরকারের সময়ে যেটি ছিল ২১.৫১ শতাংশ, সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৩০. ৭৯ শতাংশ।

পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারও সঙ্গত কারণে ক্ষুদ্র অর্থনীতির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী দৃষ্টি (পিপলস লেন্স) থাকা খুবই জরুরি হয়ে গেছে। শুধু জিডিপির ওপর আলোচনাটা সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের সমতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও নাগরিকের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে।”

তার মতে, “বর্তমান বাস্তবতায় পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। প্রথমত, আমাদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী রোগের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রনিক রোগ মোকাবিলার জন্য একটি নতুন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, নারীপ্রধান পরিবারগুলো সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তরে পড়ে আছে, তাই তাদের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ঋণের বোঝা বাড়ছে, যা একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে। চতুর্থত, ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। এটি এখনো ব্যাপক আকারে হয়নি, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং যা উদ্বেগজনক। পঞ্চমত, স্যানিটেশন সংকট উত্তরণ করে এসডিজি অর্জনের জন্য আমাদের হাতে মাত্র পাঁচ বছর আছে, কিন্তু এখনো প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ নন-স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করছে।
কর্মসংস্থান নিয়ে হোসেন জিল্লুর বলেন, “আমাদের মাঝে এখন কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বেকারত্বের দুর্যোগের বাস্তবতার মধ্যে আমরা অবস্থান করছি। কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের ভাবনা এবং জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ বিষয়ে এখনই আমাদের আলোচনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”

বিশ্লেষকরা যা বলছেন
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “২০২২ সালের বিবিএস-এর হাউজহোল্ড জরিপের সাথে এবার পিপিআরসির জরিপ তুলনা না করেও বলা যায় যে, দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে। সেটা হয়তো শতাংশ হিসাবে একটু কম-বেশি হতে পারে, কোভিড পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে আগের সরকারের শেষ দিকে এবং অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে অর্থনৈতিক যে অবস্থা, সেটার আলোকে মোটামুটি সবাই বলবেন যে, দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে। কিন্তু সেটা ২৭ শতাংশ হয়েছে, না তার চেয়ে বেশি বা কম, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মূল কথা হলো- দারিদ্র বেড়েছে।”

“বিগত দুই-তিন বছর ধরে আমরা একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছি এবং সেটা বহাল আছে। এর ফলে যারা দরিদ্র ছিল, তারা আরো দরিদ্র হয়েছে। যারা নিম্ন আয়ের, তারা দরিদ্র সীমার নিচে চলে গেছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার তো চার শতাংশের নিচে নেমে গেছে। নতুন অর্থ বছরেও অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজমান। দেশি বা বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারীই বর্তমান আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতে চাইছেন না। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বেকারত্ব বাড়ছে,” বলেন তিনি।

তার মতে, “সবচেয়ে বড় সংকট হলো, এখানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে যারা গরিব, তারা কম খাচ্ছেন বা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছেন না। চালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। তারপরও শুধু ভাত খেলে তো আর পুষ্টির অভাব পুরণ হয় না। এটা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে নারী ও শিশুদের। তারা স্থায়ী পুষ্টিহীনতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন, যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।”

তার অভিমত, “দেশে যতক্ষণ না একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়, রাজনৈকি পরিস্থিতি যতক্ষণ না স্থিতিশীল হবে, তার আগে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। ”

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন্দ নীলোর্মি বলেন, “আমরা শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনেও বলেছি যে, সরকার যে বলেছে দারিদ্র্য কমেছে, তার মধ্যে ফাঁক আছে। এখানে এমন লোকও আছেন, যারা বছরে দুই দিন কাজ না পেলেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। টোকা দিলেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। একে আমরা বলি, টোকা দেয়া দারিদ্র্য। কোভিডের পরে তো আমাদের কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। বরং, আরো কমেছে। গত বছর কিন্তু আমাদের সেফটি নেটের টাকা পৌঁছায়নি। সেফটি নেট বলতে ভাতা বলছি না। সেটাও পৌঁছায়নি। সেফটি নেট হলো, বেশ কিছু কাজ থাকতো, যেটা খারাপ সময়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতো। সেই টাকাটা দেয়া হয়নি। স্থানীয় সরকার ছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশিরভাগ কাজ হয়নি। সেটাও দারিদ্র্যের কারণ। আমি মনে করি, মোট দাগে দারিদ্র্য বাড়ার যে তথ্য, সেটা সঠিক। সেটা বর্তমান দারিদ্র্য অবস্থাকে রিপ্রেজেন্ট করে।”

“খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার একটি বড় কারণ হলো, এখন কমার্শিয়াল অ্যাগ্রিকালচার হচ্ছে। ফলে খাদ্য কিনে খেতে হচ্ছে। অল্প কিছু উৎপাদন করে অনেক কিছু কিনে খেতে হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষির আগের চরিত্র নাই। শহরে এটা আরো জটিল। কারণ, শহরে ওএমএস ছাড়া আর কোনো সাপোর্ট নাই। উত্তরবঙ্গে মঙ্গার কথা আমরা বলি। সেখানে কি ফসল হয় না? হয়, কিন্তু বিক্রি হয়ে যায়,” বলেন তিনি।

তার কথা, “আরো মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যাতে পারে। আমাদের প্রতিবেদনে আমরা তা বলেছি। কারণ অনেকেই আছেন একজন প্রান্তসীমায়। দুইদিন কাজ না থাকলেই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবেন।”

জনপ্রিয় সংবাদ

ট্রাম্পের কৃষিপণ্য শুল্ক ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে পারে ভারতের রপ্তানি

বাংলাদেশে বেড়ে চলা দারিদ্র্যের কশাঘাত

০১:১৯:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

২০২২ সালে বাংলাদেশে দরিদ্রতার হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, তা এখন বেড়ে ২৭.৯৩ শতাংশ হয়েছে। অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)৷

সোমবার পিপিআরসি এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস)-এর যৌথ উদ্যোগে ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটিতে এসব তথ্য জানানো হয়। গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। গত মে মাসে আট হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে এ গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেব অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ এবং অতি দরিদ্রের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। পিপিআরসির গবেষণায় দেখা গেছে, অতি দারিদ্র্যও তিন বছর পর বেড়ে ৯.৩৫ শতাংশ হয়েছে। দারিদ্র্য বেড়ে হয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশ। পিপিআরসি বলছে, এখনো দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার যে-কোনো সময় গরিব হয়ে যেতে পারে।

পারিবারিক আয় কোথায় কেমন
গবেষণা বলছে, শহরে পরিবারের মাসিক আয় কমেছে, তবে খরচ বেড়েছে । শহরের একটি পরিবারের এখন গড়ে মাসিক আয় ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা। গড়ে খরচ হয় ৪৪ হাজার ৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা। গ্রামের পরিবারের গড় আয় কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের একটি পরিবারের এখন গড় আয় ২৯ হাজার ২০৫ টাকা আর গড় খরচ ২৭ হাজার ১৬২ টাকা। ২০২২ সালে গ্রামের পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা।

জাতীয়ভাবে একটি পরিবারের মাসে গড় আয় ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। খরচ হয় ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা। সঞ্চয় থাকে না বললেই চলে।

সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ১২.২ শতাংশ সপ্তাহে অন্তত এক বেলা না খেয়ে থাকেন। এছাড়া ৯ শতাংশ মানুষ মাসে অন্তত একদিন না খেয়ে থেকেছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার অভাবের কথাও বলা হয়েছে পিপিআরসির গবেষণা প্রতিবেদনে।

সেখানে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিচালিতসামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির১৬.৫ শতাংশ গরিবরা পায় না। এছাড়া যারা গরিব নয়, তবে যে-কোনো সময় গরিব হতে পারে, এমন ২৭. ৫ শতাংশ মানুষ সরকারি বিভিন্ন ভাতা পান। এই দুটি বিষয় মেলালে দেখা যায়, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে ৪৪. ৩০ শতাংশই সঠিক মানুষ পাচ্ছেন না।

খাবারেই বেশি খরচ
একটি পরিবারের মাসের মোট খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যায় খাবার কিনতে। খাবার কিনতে একটি পরিবার মাসে গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা খরচ করে। এ ছাড়া প্রতি মাসে শিক্ষায় এক হাজার ৮২২ টাকা, চিকিৎসায় এক হাজার ৫৫৬ টাকা, যাতায়াতে এক হাজার ৪৭৮ টাকা ও আবাসনে এক হাজার ৮৯ টাকা খরচ হয়।

চলমান তিন সংকট
পিপিআরসি বলেছে, দেশে এখন তিন ধরনের সংকটের প্রভাব চলমান। এগুলো হলো : কোভিড (২০২০-২০২২), মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। পিপিআরসির মতে , গত বছরের আগস্টের পর ঘুস কমলেও তা বন্ধ হয়নি। গত বছরের আগস্ট মাসের আগে গবেষণায় মতামত প্রদানকারীদের ৮ .৫৪ শতাংশ সেবা নিতে ঘুস দিয়েছেন। আগস্ট মাসের পর এই হার ৩. ৬৯ শতাংশে নেমেছে। সবচেয়ে বেশি ঘুস দেয়া হয়েছে সরকারি অফিসে। এরপরে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের। তবে কোনো কাজ করতে গিয়ে ঝামেলা এড়াতে বেশি ঘুস দিচ্ছে মানুষ। গত সরকারের সময়ে যেটি ছিল ২১.৫১ শতাংশ, সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৩০. ৭৯ শতাংশ।

পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারও সঙ্গত কারণে ক্ষুদ্র অর্থনীতির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী দৃষ্টি (পিপলস লেন্স) থাকা খুবই জরুরি হয়ে গেছে। শুধু জিডিপির ওপর আলোচনাটা সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের সমতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও নাগরিকের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে।”

তার মতে, “বর্তমান বাস্তবতায় পাঁচটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। প্রথমত, আমাদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী রোগের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। ক্রনিক রোগ মোকাবিলার জন্য একটি নতুন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, নারীপ্রধান পরিবারগুলো সমাজের সবচেয়ে নিচের স্তরে পড়ে আছে, তাই তাদের বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ঋণের বোঝা বাড়ছে, যা একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে। চতুর্থত, ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। এটি এখনো ব্যাপক আকারে হয়নি, তবে ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং যা উদ্বেগজনক। পঞ্চমত, স্যানিটেশন সংকট উত্তরণ করে এসডিজি অর্জনের জন্য আমাদের হাতে মাত্র পাঁচ বছর আছে, কিন্তু এখনো প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ নন-স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করছে।
কর্মসংস্থান নিয়ে হোসেন জিল্লুর বলেন, “আমাদের মাঝে এখন কর্মসংস্থানের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বেকারত্বের দুর্যোগের বাস্তবতার মধ্যে আমরা অবস্থান করছি। কর্মসংস্থান নিয়ে বড় ধরনের ভাবনা এবং জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ বিষয়ে এখনই আমাদের আলোচনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”

বিশ্লেষকরা যা বলছেন
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “২০২২ সালের বিবিএস-এর হাউজহোল্ড জরিপের সাথে এবার পিপিআরসির জরিপ তুলনা না করেও বলা যায় যে, দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে। সেটা হয়তো শতাংশ হিসাবে একটু কম-বেশি হতে পারে, কোভিড পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে আগের সরকারের শেষ দিকে এবং অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে অর্থনৈতিক যে অবস্থা, সেটার আলোকে মোটামুটি সবাই বলবেন যে, দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। অতি দারিদ্র্যও বেড়েছে। কিন্তু সেটা ২৭ শতাংশ হয়েছে, না তার চেয়ে বেশি বা কম, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মূল কথা হলো- দারিদ্র বেড়েছে।”

“বিগত দুই-তিন বছর ধরে আমরা একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছি এবং সেটা বহাল আছে। এর ফলে যারা দরিদ্র ছিল, তারা আরো দরিদ্র হয়েছে। যারা নিম্ন আয়ের, তারা দরিদ্র সীমার নিচে চলে গেছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার তো চার শতাংশের নিচে নেমে গেছে। নতুন অর্থ বছরেও অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজমান। দেশি বা বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারীই বর্তমান আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করতে চাইছেন না। ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বেকারত্ব বাড়ছে,” বলেন তিনি।

তার মতে, “সবচেয়ে বড় সংকট হলো, এখানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে যারা গরিব, তারা কম খাচ্ছেন বা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছেন না। চালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। তারপরও শুধু ভাত খেলে তো আর পুষ্টির অভাব পুরণ হয় না। এটা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে নারী ও শিশুদের। তারা স্থায়ী পুষ্টিহীনতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন, যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি।”

তার অভিমত, “দেশে যতক্ষণ না একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়, রাজনৈকি পরিস্থিতি যতক্ষণ না স্থিতিশীল হবে, তার আগে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। ”

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন্দ নীলোর্মি বলেন, “আমরা শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনেও বলেছি যে, সরকার যে বলেছে দারিদ্র্য কমেছে, তার মধ্যে ফাঁক আছে। এখানে এমন লোকও আছেন, যারা বছরে দুই দিন কাজ না পেলেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। টোকা দিলেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। একে আমরা বলি, টোকা দেয়া দারিদ্র্য। কোভিডের পরে তো আমাদের কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। বরং, আরো কমেছে। গত বছর কিন্তু আমাদের সেফটি নেটের টাকা পৌঁছায়নি। সেফটি নেট বলতে ভাতা বলছি না। সেটাও পৌঁছায়নি। সেফটি নেট হলো, বেশ কিছু কাজ থাকতো, যেটা খারাপ সময়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতো। সেই টাকাটা দেয়া হয়নি। স্থানীয় সরকার ছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশিরভাগ কাজ হয়নি। সেটাও দারিদ্র্যের কারণ। আমি মনে করি, মোট দাগে দারিদ্র্য বাড়ার যে তথ্য, সেটা সঠিক। সেটা বর্তমান দারিদ্র্য অবস্থাকে রিপ্রেজেন্ট করে।”

“খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার একটি বড় কারণ হলো, এখন কমার্শিয়াল অ্যাগ্রিকালচার হচ্ছে। ফলে খাদ্য কিনে খেতে হচ্ছে। অল্প কিছু উৎপাদন করে অনেক কিছু কিনে খেতে হচ্ছে। গ্রামীণ কৃষির আগের চরিত্র নাই। শহরে এটা আরো জটিল। কারণ, শহরে ওএমএস ছাড়া আর কোনো সাপোর্ট নাই। উত্তরবঙ্গে মঙ্গার কথা আমরা বলি। সেখানে কি ফসল হয় না? হয়, কিন্তু বিক্রি হয়ে যায়,” বলেন তিনি।

তার কথা, “আরো মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যাতে পারে। আমাদের প্রতিবেদনে আমরা তা বলেছি। কারণ অনেকেই আছেন একজন প্রান্তসীমায়। দুইদিন কাজ না থাকলেই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবেন।”