১০:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
চীন-আমেরিকা সম্পর্কের নতুন বিতর্ক: $১৩ বিলিয়ন বিটকয়েন হ্যাকিংয়ের অভিযোগ পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-১২৪) শেখ হাসিনার রায় কবে, জানা যাবে আজ পাকিস্তানে দরিদ্র্যর সংখ্যা বিশ্বব্যাংক ও সরকার নানা ভাবে নির্ধারণ থাই রাজার ঐতিহাসিক চীন সফর: ১৯৪৯ সালের পর প্রথমবার কোনো থাই সম্রাটের বেইজিং যাত্রা উমর নবি: যিনি ‘সাদা কলার গ্রুপ’কে উত্সাহিত করেছিলেন প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২৩) দ্বিতীয় মার্কিন তেল চালানঃ ১ মিলিয়ন ব্যারেল নিয়ে পাকিস্তানে পৌঁছেছে সাগর পাবলিশার্স, পাকিস্তানী চরিত্র ও “আওয়ামী লীগ আঁচাচ্ছে” সাইকেল যোজনার দুই দশক: নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব

শান্তিরক্ষী বাহিনী বিলুপ্তির চাপে, ইসরায়েলের দাবি—মিশন এখন অপ্রয়োজনীয়

শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে নতুন বিতর্ক
প্রায় অর্ধশতক ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা ইসরায়েল ও দক্ষিণ লেবাননের সীমান্ত এলাকায় টহল দিচ্ছে। এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রভাবাধীন। কিন্তু এখন জাতিসংঘের এই শান্তিরক্ষা মিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত বছরের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সর্বাত্মক যুদ্ধের পর জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী (ইউএনআইএফআইএল) বিলুপ্ত করার দাবি জোরালো হয়েছে। এ সপ্তাহেই তাদের বার্ষিক ম্যান্ডেট নবায়নের সময়।

ইসরায়েলের দাবি ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইউএনআইএফআইএলের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল একাধিকবার শান্তিরক্ষীদের ওপর গুলি চালিয়েছে এবং ডজনখানেককে আহত করেছে। ইসরায়েলের মতে, হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়ায় এই মিশনের আর প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে লেবানন ও ইউরোপীয় কূটনীতিকরা সতর্ক করে বলেছেন, এই বাহিনী প্রত্যাহার হলে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি হুমকির মুখে পড়বে। ইউএনআইএফআইএলের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিকোলা মানদোলেসি বলেন, “পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল।”

শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা ও সমালোচনা
১৯৭৮ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের সময় গঠিত এই বাহিনীতে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার শান্তিরক্ষী আছে। কয়েক দশক ধরে তারা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে বাফার হিসেবে কাজ করছে।
তবে তাদের সীমিত ক্ষমতা—শুধু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন দেওয়া, প্রয়োজনে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া, অনেকের কাছে অকার্যকর মনে হয়েছে।
হিজবুল্লাহ সমর্থকরা তাদের বিদেশি হস্তক্ষেপকারী মনে করে, আর ইসরায়েলের দৃষ্টিতে তারা অকার্যকর ও দাঁতহীন।

যুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বংসস্তূপে টহল
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রেক্ষিতে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের দিকে রকেট ছোড়ে। প্রায় এক বছরের পাল্টাপাল্টি আক্রমণের পর ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়ে। এতে হিজবুল্লাহর বহু শীর্ষ নেতা, হাজারো যোদ্ধা ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয় এবং লেবাননের বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়।
যুদ্ধবিরতির মাস কয়েক পরও দক্ষিণ লেবাননের বহু এলাকা ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। অল্প কিছু বাসিন্দা কেবল ভগ্নাবশেষে নিজেদের ঘর খুঁজে ফেরেন। শান্তিরক্ষীদের টহল বহর কাঁচা রাস্তায় অগ্রসর হতে গিয়ে কবর ও অবিস্ফোরিত গোলার খোলস এড়িয়ে চলে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির জটিলতা
চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবানন থেকে সরে যাবে এবং লেবাননের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষীদের সহায়তায় সেখানে মোতায়েন হবে। কিন্তু ইসরায়েল অভিযোগ করছে, হিজবুল্লাহ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে এবং লেবানন কার্যকরভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এ কারণে ইসরায়েল এখনো লেবাননে কিছু সামরিক অবস্থান ধরে রেখেছে, যা নিজেই চুক্তি ভঙ্গের শামিল।
এই পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহ দেশি-বিদেশি চাপে অস্ত্র সমর্পণ করতে অনিচ্ছুক।

শান্তিরক্ষীদের দৈনন্দিন বাস্তবতা
শান্তিরক্ষীদের প্রতিদিনের টহল এখন অনিশ্চয়তায় ভরা। ইতালীয় কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিউসেপ্পে ফালোসসি আকাশের দিকে তাকিয়ে সতর্ক করেন—একটি ইসরায়েলি ড্রোন ঘুরছে। ট্যাংকের চাপে ভেঙে যাওয়া রাস্তা, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ির ওপর উড়ছে হিজবুল্লাহর পতাকা।
লেবাননের সেনাদের সঙ্গে যৌথ টহলে শান্তিরক্ষীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত চেকপয়েন্টে পৌঁছান। একজন লেবাননের অফিসার নিজের শরীরের দাগ দেখিয়ে জানান, কীভাবে ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলার শার্পনেলে তিনি আহত হয়েছিলেন।

ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে লেবাননের সেনাদের ওপর
ইউএনআইএফআইএল কমান্ডার মানদোলেসি বলেন, শান্তিরক্ষীদের কাজ কেবল পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন দেওয়া, প্রয়োগ নয়। প্রকৃত দায়িত্ব লেবাননের সেনাবাহিনীর—হিজবুল্লাহর টানেল ও অস্ত্রাগার ধ্বংস করা।
তিনি বলেন, “দক্ষিণ লেবাননের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে লেবাননের সেনাবাহিনীই মূল চাবিকাঠি।”

অনিশ্চয়তার মাঝে আশা
শান্তিরক্ষীরা এখনও ঝুঁকি নিয়ে টহল দিচ্ছে। এক টহলে ইতালীয় বাহিনীর বোমা শনাক্তকারী কুকুর ‘স্ল্যাশ’ সম্ভাব্য বিস্ফোরক খুঁজে বের করে। পরে জানা যায়, সেটি কেবল মর্টার খোলসের একটি অংশ। মুহূর্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন সবাই।

এইভাবে জাতিসংঘের লেবানন মিশন এখন টিকে থাকা না থাকার সন্ধিক্ষণে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি, ইসরায়েলি অবস্থান ও লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা—সব মিলিয়ে এর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

চীন-আমেরিকা সম্পর্কের নতুন বিতর্ক: $১৩ বিলিয়ন বিটকয়েন হ্যাকিংয়ের অভিযোগ

শান্তিরক্ষী বাহিনী বিলুপ্তির চাপে, ইসরায়েলের দাবি—মিশন এখন অপ্রয়োজনীয়

১২:৩৫:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫

শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে নতুন বিতর্ক
প্রায় অর্ধশতক ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা ইসরায়েল ও দক্ষিণ লেবাননের সীমান্ত এলাকায় টহল দিচ্ছে। এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রভাবাধীন। কিন্তু এখন জাতিসংঘের এই শান্তিরক্ষা মিশনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত বছরের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সর্বাত্মক যুদ্ধের পর জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী (ইউএনআইএফআইএল) বিলুপ্ত করার দাবি জোরালো হয়েছে। এ সপ্তাহেই তাদের বার্ষিক ম্যান্ডেট নবায়নের সময়।

ইসরায়েলের দাবি ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইউএনআইএফআইএলের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল একাধিকবার শান্তিরক্ষীদের ওপর গুলি চালিয়েছে এবং ডজনখানেককে আহত করেছে। ইসরায়েলের মতে, হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়ায় এই মিশনের আর প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে লেবানন ও ইউরোপীয় কূটনীতিকরা সতর্ক করে বলেছেন, এই বাহিনী প্রত্যাহার হলে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি হুমকির মুখে পড়বে। ইউএনআইএফআইএলের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিকোলা মানদোলেসি বলেন, “পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল।”

শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা ও সমালোচনা
১৯৭৮ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের সময় গঠিত এই বাহিনীতে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার শান্তিরক্ষী আছে। কয়েক দশক ধরে তারা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে বাফার হিসেবে কাজ করছে।
তবে তাদের সীমিত ক্ষমতা—শুধু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন দেওয়া, প্রয়োজনে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া, অনেকের কাছে অকার্যকর মনে হয়েছে।
হিজবুল্লাহ সমর্থকরা তাদের বিদেশি হস্তক্ষেপকারী মনে করে, আর ইসরায়েলের দৃষ্টিতে তারা অকার্যকর ও দাঁতহীন।

যুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বংসস্তূপে টহল
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রেক্ষিতে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের দিকে রকেট ছোড়ে। প্রায় এক বছরের পাল্টাপাল্টি আক্রমণের পর ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়ে। এতে হিজবুল্লাহর বহু শীর্ষ নেতা, হাজারো যোদ্ধা ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয় এবং লেবাননের বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়।
যুদ্ধবিরতির মাস কয়েক পরও দক্ষিণ লেবাননের বহু এলাকা ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। অল্প কিছু বাসিন্দা কেবল ভগ্নাবশেষে নিজেদের ঘর খুঁজে ফেরেন। শান্তিরক্ষীদের টহল বহর কাঁচা রাস্তায় অগ্রসর হতে গিয়ে কবর ও অবিস্ফোরিত গোলার খোলস এড়িয়ে চলে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির জটিলতা
চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবানন থেকে সরে যাবে এবং লেবাননের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষীদের সহায়তায় সেখানে মোতায়েন হবে। কিন্তু ইসরায়েল অভিযোগ করছে, হিজবুল্লাহ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে এবং লেবানন কার্যকরভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এ কারণে ইসরায়েল এখনো লেবাননে কিছু সামরিক অবস্থান ধরে রেখেছে, যা নিজেই চুক্তি ভঙ্গের শামিল।
এই পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহ দেশি-বিদেশি চাপে অস্ত্র সমর্পণ করতে অনিচ্ছুক।

শান্তিরক্ষীদের দৈনন্দিন বাস্তবতা
শান্তিরক্ষীদের প্রতিদিনের টহল এখন অনিশ্চয়তায় ভরা। ইতালীয় কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিউসেপ্পে ফালোসসি আকাশের দিকে তাকিয়ে সতর্ক করেন—একটি ইসরায়েলি ড্রোন ঘুরছে। ট্যাংকের চাপে ভেঙে যাওয়া রাস্তা, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ির ওপর উড়ছে হিজবুল্লাহর পতাকা।
লেবাননের সেনাদের সঙ্গে যৌথ টহলে শান্তিরক্ষীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত চেকপয়েন্টে পৌঁছান। একজন লেবাননের অফিসার নিজের শরীরের দাগ দেখিয়ে জানান, কীভাবে ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলার শার্পনেলে তিনি আহত হয়েছিলেন।

ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে লেবাননের সেনাদের ওপর
ইউএনআইএফআইএল কমান্ডার মানদোলেসি বলেন, শান্তিরক্ষীদের কাজ কেবল পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন দেওয়া, প্রয়োগ নয়। প্রকৃত দায়িত্ব লেবাননের সেনাবাহিনীর—হিজবুল্লাহর টানেল ও অস্ত্রাগার ধ্বংস করা।
তিনি বলেন, “দক্ষিণ লেবাননের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে লেবাননের সেনাবাহিনীই মূল চাবিকাঠি।”

অনিশ্চয়তার মাঝে আশা
শান্তিরক্ষীরা এখনও ঝুঁকি নিয়ে টহল দিচ্ছে। এক টহলে ইতালীয় বাহিনীর বোমা শনাক্তকারী কুকুর ‘স্ল্যাশ’ সম্ভাব্য বিস্ফোরক খুঁজে বের করে। পরে জানা যায়, সেটি কেবল মর্টার খোলসের একটি অংশ। মুহূর্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন সবাই।

এইভাবে জাতিসংঘের লেবানন মিশন এখন টিকে থাকা না থাকার সন্ধিক্ষণে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি, ইসরায়েলি অবস্থান ও লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা—সব মিলিয়ে এর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।