বাংলাদেশ সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি দ্রুত ও পর্যাপ্ত সহায়তা না দেয়, তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট আর বহন করা দেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রায় আট বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযানের পর যে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা এখনো ফিরে যেতে পারেনি। বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচরে বসবাস করছে প্রায় ১৩ লাখ শরণার্থী, যা বিশ্বে এককভাবে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।
কিন্তু ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে বাংলাদেশ বলছে, আর্থিক, সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে এই বোঝা বহন করা দেশের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। একই সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে, মধ্যপ্রাচ্য, সাহেল অঞ্চল ও ইউরোপ শরণার্থী সঙ্কটে বিপর্যস্ত, আর বাংলাদেশের মধ্যেই কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যে। ফলে প্রশ্ন জাগছে—এই পরিস্থিতির নিকট ভবিষ্যৎ কী?
রোহিঙ্গা সঙ্কট: অর্থের অভাব ও মানবিক বিপর্যয়
জাতিসংঘের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা (JRP) ২০২৫ সালে প্রায় ৯৩৪.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা চেয়েছে। এই অর্থ কেবল রোহিঙ্গাদের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য নয়; স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও সহায়তা করার কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এর অর্ধেকেরও কম অর্থ এসেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (UNHCR) নিজেই বলছে, তারা কেবল ৩০ শতাংশ অর্থ সংগ্রহ করতে পেরেছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের খাদ্য রেশন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। আগে যেখানে প্রতিটি পরিবার মাসে ১২ ডলারের খাবার ভাউচার পেত, এখন সেটি নেমে এসেছে ৮ ডলারে। এর ফলে প্রোটিন, শাকসবজি ও ডাল প্রায় অপ্রাপ্য হয়ে পড়েছে। অনাহার ও অপুষ্টি বাড়ছে শিশুদের মধ্যে।

ইউনিসেফ (UNICEF) জানিয়েছে, অর্থের অভাবে ২.৩ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে। কক্সবাজার ক্যাম্পের অনেক শিক্ষাকেন্দ্র ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল থেকে বঞ্চিত হওয়ায় শিশুরা ঝুঁকছে শিশুশ্রম ও অল্পবয়সে বিয়ের দিকে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় অর্ধলক্ষ মেয়েশিশু অল্পবয়সে বিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি কক্সবাজার সফরে এসে সরাসরি বলেছেন—সহায়তা বন্ধ করা বা কমিয়ে দেওয়া এক ধরনের “অপরাধ”। তিনি বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করেছেন যে, খাদ্য ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত একটি জনগোষ্ঠী দ্রুত হতাশা ও সহিংসতার দিকে ধাবিত হতে পারে।
বাংলাদেশের সীমিত সামর্থ্য
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “দেশটির আর্থিক, পরিবেশগত ও প্রশাসনিক সক্ষমতা প্রায় শেষ। এখন আর এই বোঝা বহন সম্ভব নয়।”
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদ ব্যয় করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশাসনিক খরচ। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন ও শিবির পরিচালনায় প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যয় করছে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার।
একই সময়ে, দেশের অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে চাপে রয়েছে। ফলে সরকার বলছে, শরণার্থী সঙ্কট বহন করা এখন কার্যত অসম্ভব।
![]()
স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বাসিন্দা কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, “আগে আমরা এই পাহাড়ি এলাকায় ফসল ফলাতাম। এখন শরণার্থীদের কারণে জমি দখল হয়ে গেছে। কাঠ ও বাঁশ কেটে নেওয়ায় পাহাড় ভেঙে যাচ্ছে, বন্যার ঝুঁকিও বেড়েছে।”
স্থানীয় দোকানদার রুবিনা আক্তার জানান, “শরণার্থীরা বাজারে আসায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। অনেকেই বিদেশি সংস্থা থেকে সহায়তা পেয়ে পণ্য কম দামে বিক্রি করে। এতে আমাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
অন্যদিকে, স্থানীয় মানুষ মনে করেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা শুধু শরণার্থীদের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে, অথচ তাদেরও জীবনযাত্রার খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সামাজিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে।
খাদ্য সংকট: বাংলাদেশে ক্ষুধার বিস্তার
শুধু শরণার্থীরাই নয়, বাংলাদেশ নিজেও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মারাত্মক সংকটে পড়েছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (২০২৪)-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্কোর ১৯.৪, যা “মধ্যম ক্ষুধা” ক্যাটাগরিতে পড়ে। ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম।
![]()
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ২৩.৬ মিলিয়ন মানুষ বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে একজন প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক IPC (Integrated Food Security Phase Classification) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে পড়বে। এ সময়ে কিছু অঞ্চলে “সংকট” থেকে “জরুরি” পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: প্রতিযোগিতামূলক সংকট
বাংলাদেশের দাবি শুধু অর্থসংস্থানেই আটকে নেই, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের গাজা ও ইয়েমেন, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইউরোপে অভিবাসী সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ফলে রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় পিছিয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ। এত বেশি প্রতিযোগিতামূলক সংকটের মধ্যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নিকট ভবিষ্যৎ: সম্ভাব্য দৃশ্যপট
১. মানবিক বিপর্যয়ের গভীরতা বৃদ্ধি: শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য সেবায় কাটছাঁট চলতে থাকলে রোহিঙ্গারা আরও হতাশ ও অসহায় হয়ে পড়বে। শিশুদের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাবে দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার অন্ধকারে।
২. বাংলাদেশে সামাজিক চাপ: শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিরোধ বাড়তে পারে। কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতা, বাজারে চাপ ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
৩. প্রত্যাবর্তনের অনিশ্চয়তা: মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অস্থির। সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বা অধিকার দিতে রাজি নয়। ফলে প্রত্যাবর্তনের কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া আসন্ন ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না।
৪. খাদ্য ও পুষ্টির অবনতি: বৈশ্বিক খাদ্য ঘাটতি ও বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মিলিয়ে ক্ষুধার মাত্রা “গুরুতর” অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। শিশুদের অপুষ্টি আরও বেড়ে যাবে।
৫. আঞ্চলিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি: ইতিমধ্যেই শত শত রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে প্রাণ হারিয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও বাড়লে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য তা এক বড় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।

কৌশলগত করণীয়
- • আন্তর্জাতিক অর্থায়ন: জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে হবে।
- • শিক্ষা ও সুরক্ষা: শিশুদের শিক্ষাকেন্দ্র পুনরায় চালু ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে বিশেষ কর্মসূচি দরকার।
- • খাদ্য সহায়তা: রেশন বাড়ানো, ভাউচার সিস্টেম কার্যকর করা ও স্থানীয় কৃষিকে সহায়তা দিতে হবে।
- • প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনা: মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের রূপরেখা নিশ্চিত করা জরুরি।
- • জবাবদিহি ও বিচার: আন্তর্জাতিক আদালত ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় অর্থায়ন নিশ্চিত করে মিয়ানমারের অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
- • বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা: শুধু শরণার্থী নয়, স্থানীয় জনগণের জন্যও কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এখন সময় অত্যন্ত কঠিন। একদিকে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও দারিদ্র্য, অন্যদিকে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক দায়িত্ব—এই দ্বৈত বোঝা বহন করা কোনোভাবেই সহজ নয়। আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গা সঙ্কট অচিরেই এক গভীর মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হবে।
তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সমন্বিতভাবে সহায়তা বাড়ায়, শিক্ষা ব্যবস্থা ও খাদ্য সহায়তা পুনঃস্থাপন করে এবং মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে একটি নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের রূপরেখা তৈরি করতে পারে, তবে এখনো আশার আলো রয়েছে। অন্যথায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের ভাগ্য উভয়ই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বাধ্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















