১১:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
 সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা তাইওয়ানের স্যাটেলাইট যুগের সূচনা: স্পেসএক্স উৎক্ষেপণে বড় অগ্রগতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৫৯) শেয়ারবাজারে টানা উত্থান, বিনিয়োগকারীদের মনোভাব আরও ইতিবাচক সিরাজগঞ্জে ব্র্যাক–ফিলিপস ফাউন্ডেশনের নতুন চার হেলথ সেন্টার প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমলেও আস্থার লড়াইয়ে এগোচ্ছে চীন কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসী নন- ওমর আব্দুল্লাহ গোপন সস রক্ষায় কঠোর নজরদারি: রেইজিং কেইনসের রহস্যময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সিআইএ–এর মূল্যায়নকে অস্বীকার করলেন ট্রাম্প ট্রাম্পের কৃষিপণ্য শুল্ক ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে পারে ভারতের রপ্তানি

চিংড়ি চাষ ও লবণাক্ত পানির দখল: দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার হারিয়ে যাওয়া ফলের বাগান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল—বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী এবং কক্সবাজার—একসময় ছিল ফলের প্রাচুর্যে ভরপুর অঞ্চল। নারকেল, কাঁঠাল, লিচু, সুপারি, পেয়ারা থেকে শুরু করে আম, জাম, বেল—সব ধরনের ফল গাছেই ভরপুর ছিল এই জনপদ। স্থানীয় কৃষকের জীবন ধারণের মূল ভিত্তি ছিল এই ফলগাছ এবং ধানক্ষেত। কিন্তু আশির দশক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মোহে শুরু হওয়া ব্যাপক চিংড়ি চাষ ধীরে ধীরে পাল্টে দিয়েছে এই এলাকার ভূপ্রকৃতি। কৃষি এবং সামাজিক জীবনও বদলে গেছে।

আজ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বড় অংশজুড়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা হলো লবণাক্ত পানিতে ভরা চিংড়ির ঘের আর শুকিয়ে যাওয়া ফলগাছের কঙ্কাল। এই পরিবর্তন শুধু কৃষি অর্থনীতিকে নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনকেও সংকটে ফেলেছে।

চিংড়ি চাষের শুরু ও বিস্তার

আশির দশকে সরকার চিংড়ি রপ্তানিকে “কালো সোনা” হিসেবে অভিহিত করে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা দ্রুত বাড়ছিল। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা প্রথমে ধানক্ষেত বা ফলের বাগানের একটি অংশকে চিংড়ির ঘেরে পরিণত করে। নদী থেকে খাল কেটে আনা হয় লবণাক্ত পানি। অল্প সময়েই কৃষকরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন।

কিন্তু এই লাভ ছিল স্বল্পমেয়াদি। মাটিতে একবার লবণ প্রবেশ করার পর তা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ফলে, একসময়ের উর্বর জমি আর ফল চাষের উপযোগী থাকে না।

লবণ চাষের জমিতে চিংড়ি ঘের, কমছে লবণের উৎপাদন

লবণাক্ত পানির প্রসার: কৃষি ও মাটির ক্ষতি

চিংড়ির ঘেরে ব্যবহৃত লবণাক্ত পানি জমির ভেতরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলাফল—

  • • মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়।
  • • ধান ও শাক সবজির ফলন কমে যায়।
  • • নারকেল, কাঁঠাল, লিচু, সুপারি ও পেয়ারার মতো ফলগাছ শুকিয়ে যায়।

বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে, যেখানে আগে বিস্তীর্ণ নারকেল ও সুপারির বাগান ছিল, সেখানে এখন শুকনো জমি আর চিংড়ির ঘের ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।

সাতক্ষীরার অভিজ্ঞতা

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলছিলেন—

“আমাদের গ্রামে একসময় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় নারকেল গাছ থাকত। এখন গুনেগুনে হাতে গোনা কয়েকটা গাছ টিকে আছে। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ার পর গাছগুলো একে একে শুকিয়ে গেছে।”

জেলার কৃষি দপ্তরের হিসাব বলছে, গত ২৫ বছরে সাতক্ষীরায় ফলগাছের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে নারকেল ও সুপারির উৎপাদন সর্বনাশের মুখে।

ভোলার মেঘনার ভঙ্গন রোধে ৫২২ কোটি টাকার কাজ হচ্ছে | জাতীয় | বাংলাদেশ সংবাদ  সংস্থা (বাসস)

ভোলার ভয়াবহ পরিবর্তন

ভোলা ছিল পেয়ারা ও নারকেলের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু গত এক দশকে এখানে চিংড়ি চাষের বিস্তার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে। এখন ভোলার বাজারে আগে যেসব ফল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হতো, সেগুলো বাইরের জেলা থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।

কৃষক কামাল উদ্দিন জানালেন—

“আমার বাবার সময়ে ৫০টা নারকেল গাছ থেকে বছরে গড়ে ৮-১০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন গাছ আছে মাত্র ৫টা, তাও ঠিকমতো ফল ধরে না।”

কক্সবাজারের সংকট

কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া এলাকায় একসময় আম, কাঁঠাল ও লিচুর বাগান ছিল প্রচুর। কিন্তু চিংড়ি চাষের বিস্তার এই সবুজকে ধ্বংস করেছে। বর্তমানে সেখানে ফল উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

স্থানীয় কৃষক নুরুল হক বললেন—

“আগে মৌসুমে লিচুর গাছ থেকে গ্রাম ভরে যেত। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা লিচুর নাম প্রায় শোনে না।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ শিক্ষকসহ ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক  ব্যবস্থা | প্রথম আলো

গবেষকদের মতামত

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহার করা লবণাক্ত পানি ভূগর্ভে নেমে গিয়ে ১০-১৫ বছর পরেও মাটি উর্বরতা ফিরে পায় না। ফলে, একবার যে জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়, সেখানে পরবর্তীতে ধান বা ফলগাছ ফলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

পরিবেশবিদ ড. ফরিদ আহমেদ বলছেন—

“চিংড়ি থেকে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক আয় হচ্ছে বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমরা হারাচ্ছি কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা। ফলগাছ হারানো মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি সাংস্কৃতিক ক্ষতিও।”

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি

ফলগাছ হারানো মানে শুধু খাদ্যের অভাব নয়। গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে ফলগাছের সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।

  • • ঈদ বা পূজার সময় নারকেল দিয়ে মিষ্টি তৈরি হতো।
  • • গ্রীষ্মে লিচু ও আম ছিল গ্রামের শিশু-কিশোরদের আনন্দের উৎস।
  • • কাঁঠাল ছিল গ্রামের প্রধান ফল, যা দিয়ে অনেক পরিবার খাবারের চাহিদা মেটাতো।

এখন এসব স্মৃতি ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে।

Bangladesh's Shrimp Export Rises After Years of Decline

অর্থনৈতিক ক্ষতির চিত্র

চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশকে বছরে গড়ে প্রায় ৪০-৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেয়। কিন্তু এ আয়ের ভাগ মূলত সীমিত সংখ্যক ব্যবসায়ীর হাতে যায়। অন্যদিকে, কয়েক লাখ কৃষক তাদের উর্বর জমি হারিয়ে স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছে।

ফল উৎপাদনের পরিসংখ্যান বলছে—

  • • সাতক্ষীরায় নারকেল উৎপাদন ১৯৯০ সালের তুলনায় এখন প্রায় ৭০% কম।
  • • ভোলায় পেয়ারা উৎপাদন ৫০% কমে গেছে।
  • • কক্সবাজারে কাঁঠালের বাগান প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

কৃষকের দুঃখ ও ভবিষ্যৎ

স্থানীয় কৃষকরা এখন দ্বিধায় পড়ে গেছেন। চিংড়ি ছাড়া বিকল্প ফসল ফলানো কঠিন, আবার চিংড়ি চাষ জমিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নারীরা যারা আগে নারকেল ও সুপারি বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করতেন, তারাও এখন বেকারত্বে ভুগছেন।

সাতক্ষীরার গৃহবধূ শিরিন আক্তার বলছিলেন—

“আগে নারকেল বিক্রি করে ঈদের সময় সন্তানদের জামা কিনতে পারতাম। এখন সেই আয় নেই, সব কিনতে হয় ধার করে।”

লাভজনক হলেও বাড়েনি ভেনামি চিংড়ির চাষ

সম্ভাব্য সমাধান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো সময় আছে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার।

  • • টেকসই কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
  • • লবণাক্ততা প্রতিরোধে বাঁধ ও মিঠা পানির সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
  • • বিকল্প কৃষি যেমন লবণ-সহিষ্ণু ধান ও ফলগাছ রোপণ করতে হবে।
  • • চিংড়ি চাষকে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।

চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের একটি বড় উৎস হলেও এর কারণে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক ও কৃষিজীবন ধ্বংসের মুখে। ফল গাছ হারিয়ে যাওয়ায় শুধু অর্থনীতি নয়, মানুষের সংস্কৃতি, আনন্দ, স্মৃতি—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যদি এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এই অঞ্চল একসময় সম্পূর্ণভাবে ফল গাছ শূন্য লবণাক্ত মরুভূমিতে পরিণত হবে। আর যদি সময়মতো উদ্যোগ নেওয়া যায়,  তবে আবারও নারকেল-লিচু-কাঁঠালের সবুজ ছায়ায় ফিরতে পারবে এই জনপদ।

জনপ্রিয় সংবাদ

 সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা

চিংড়ি চাষ ও লবণাক্ত পানির দখল: দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার হারিয়ে যাওয়া ফলের বাগান

০৭:০৭:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল—বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী এবং কক্সবাজার—একসময় ছিল ফলের প্রাচুর্যে ভরপুর অঞ্চল। নারকেল, কাঁঠাল, লিচু, সুপারি, পেয়ারা থেকে শুরু করে আম, জাম, বেল—সব ধরনের ফল গাছেই ভরপুর ছিল এই জনপদ। স্থানীয় কৃষকের জীবন ধারণের মূল ভিত্তি ছিল এই ফলগাছ এবং ধানক্ষেত। কিন্তু আশির দশক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মোহে শুরু হওয়া ব্যাপক চিংড়ি চাষ ধীরে ধীরে পাল্টে দিয়েছে এই এলাকার ভূপ্রকৃতি। কৃষি এবং সামাজিক জীবনও বদলে গেছে।

আজ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বড় অংশজুড়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা হলো লবণাক্ত পানিতে ভরা চিংড়ির ঘের আর শুকিয়ে যাওয়া ফলগাছের কঙ্কাল। এই পরিবর্তন শুধু কৃষি অর্থনীতিকে নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনকেও সংকটে ফেলেছে।

চিংড়ি চাষের শুরু ও বিস্তার

আশির দশকে সরকার চিংড়ি রপ্তানিকে “কালো সোনা” হিসেবে অভিহিত করে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা দ্রুত বাড়ছিল। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা প্রথমে ধানক্ষেত বা ফলের বাগানের একটি অংশকে চিংড়ির ঘেরে পরিণত করে। নদী থেকে খাল কেটে আনা হয় লবণাক্ত পানি। অল্প সময়েই কৃষকরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন।

কিন্তু এই লাভ ছিল স্বল্পমেয়াদি। মাটিতে একবার লবণ প্রবেশ করার পর তা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ফলে, একসময়ের উর্বর জমি আর ফল চাষের উপযোগী থাকে না।

লবণ চাষের জমিতে চিংড়ি ঘের, কমছে লবণের উৎপাদন

লবণাক্ত পানির প্রসার: কৃষি ও মাটির ক্ষতি

চিংড়ির ঘেরে ব্যবহৃত লবণাক্ত পানি জমির ভেতরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলাফল—

  • • মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়।
  • • ধান ও শাক সবজির ফলন কমে যায়।
  • • নারকেল, কাঁঠাল, লিচু, সুপারি ও পেয়ারার মতো ফলগাছ শুকিয়ে যায়।

বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে, যেখানে আগে বিস্তীর্ণ নারকেল ও সুপারির বাগান ছিল, সেখানে এখন শুকনো জমি আর চিংড়ির ঘের ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।

সাতক্ষীরার অভিজ্ঞতা

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলছিলেন—

“আমাদের গ্রামে একসময় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় নারকেল গাছ থাকত। এখন গুনেগুনে হাতে গোনা কয়েকটা গাছ টিকে আছে। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ার পর গাছগুলো একে একে শুকিয়ে গেছে।”

জেলার কৃষি দপ্তরের হিসাব বলছে, গত ২৫ বছরে সাতক্ষীরায় ফলগাছের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে নারকেল ও সুপারির উৎপাদন সর্বনাশের মুখে।

ভোলার মেঘনার ভঙ্গন রোধে ৫২২ কোটি টাকার কাজ হচ্ছে | জাতীয় | বাংলাদেশ সংবাদ  সংস্থা (বাসস)

ভোলার ভয়াবহ পরিবর্তন

ভোলা ছিল পেয়ারা ও নারকেলের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু গত এক দশকে এখানে চিংড়ি চাষের বিস্তার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে। এখন ভোলার বাজারে আগে যেসব ফল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হতো, সেগুলো বাইরের জেলা থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।

কৃষক কামাল উদ্দিন জানালেন—

“আমার বাবার সময়ে ৫০টা নারকেল গাছ থেকে বছরে গড়ে ৮-১০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন গাছ আছে মাত্র ৫টা, তাও ঠিকমতো ফল ধরে না।”

কক্সবাজারের সংকট

কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া এলাকায় একসময় আম, কাঁঠাল ও লিচুর বাগান ছিল প্রচুর। কিন্তু চিংড়ি চাষের বিস্তার এই সবুজকে ধ্বংস করেছে। বর্তমানে সেখানে ফল উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

স্থানীয় কৃষক নুরুল হক বললেন—

“আগে মৌসুমে লিচুর গাছ থেকে গ্রাম ভরে যেত। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা লিচুর নাম প্রায় শোনে না।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ শিক্ষকসহ ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক  ব্যবস্থা | প্রথম আলো

গবেষকদের মতামত

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহার করা লবণাক্ত পানি ভূগর্ভে নেমে গিয়ে ১০-১৫ বছর পরেও মাটি উর্বরতা ফিরে পায় না। ফলে, একবার যে জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়, সেখানে পরবর্তীতে ধান বা ফলগাছ ফলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

পরিবেশবিদ ড. ফরিদ আহমেদ বলছেন—

“চিংড়ি থেকে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক আয় হচ্ছে বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আমরা হারাচ্ছি কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা। ফলগাছ হারানো মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি সাংস্কৃতিক ক্ষতিও।”

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি

ফলগাছ হারানো মানে শুধু খাদ্যের অভাব নয়। গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে ফলগাছের সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।

  • • ঈদ বা পূজার সময় নারকেল দিয়ে মিষ্টি তৈরি হতো।
  • • গ্রীষ্মে লিচু ও আম ছিল গ্রামের শিশু-কিশোরদের আনন্দের উৎস।
  • • কাঁঠাল ছিল গ্রামের প্রধান ফল, যা দিয়ে অনেক পরিবার খাবারের চাহিদা মেটাতো।

এখন এসব স্মৃতি ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে।

Bangladesh's Shrimp Export Rises After Years of Decline

অর্থনৈতিক ক্ষতির চিত্র

চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশকে বছরে গড়ে প্রায় ৪০-৫০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেয়। কিন্তু এ আয়ের ভাগ মূলত সীমিত সংখ্যক ব্যবসায়ীর হাতে যায়। অন্যদিকে, কয়েক লাখ কৃষক তাদের উর্বর জমি হারিয়ে স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছে।

ফল উৎপাদনের পরিসংখ্যান বলছে—

  • • সাতক্ষীরায় নারকেল উৎপাদন ১৯৯০ সালের তুলনায় এখন প্রায় ৭০% কম।
  • • ভোলায় পেয়ারা উৎপাদন ৫০% কমে গেছে।
  • • কক্সবাজারে কাঁঠালের বাগান প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

কৃষকের দুঃখ ও ভবিষ্যৎ

স্থানীয় কৃষকরা এখন দ্বিধায় পড়ে গেছেন। চিংড়ি ছাড়া বিকল্প ফসল ফলানো কঠিন, আবার চিংড়ি চাষ জমিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নারীরা যারা আগে নারকেল ও সুপারি বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করতেন, তারাও এখন বেকারত্বে ভুগছেন।

সাতক্ষীরার গৃহবধূ শিরিন আক্তার বলছিলেন—

“আগে নারকেল বিক্রি করে ঈদের সময় সন্তানদের জামা কিনতে পারতাম। এখন সেই আয় নেই, সব কিনতে হয় ধার করে।”

লাভজনক হলেও বাড়েনি ভেনামি চিংড়ির চাষ

সম্ভাব্য সমাধান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো সময় আছে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার।

  • • টেকসই কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
  • • লবণাক্ততা প্রতিরোধে বাঁধ ও মিঠা পানির সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
  • • বিকল্প কৃষি যেমন লবণ-সহিষ্ণু ধান ও ফলগাছ রোপণ করতে হবে।
  • • চিংড়ি চাষকে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।

চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের একটি বড় উৎস হলেও এর কারণে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক ও কৃষিজীবন ধ্বংসের মুখে। ফল গাছ হারিয়ে যাওয়ায় শুধু অর্থনীতি নয়, মানুষের সংস্কৃতি, আনন্দ, স্মৃতি—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

যদি এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে এই অঞ্চল একসময় সম্পূর্ণভাবে ফল গাছ শূন্য লবণাক্ত মরুভূমিতে পরিণত হবে। আর যদি সময়মতো উদ্যোগ নেওয়া যায়,  তবে আবারও নারকেল-লিচু-কাঁঠালের সবুজ ছায়ায় ফিরতে পারবে এই জনপদ।