০৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
খামার থেকে উৎসবের টেবিল, টার্কির নীরব দীর্ঘ পথ নতুন জলবায়ু নিয়মে বৈশ্বিক শিপিং শিল্পের জ্বালানি রূপান্তর তারকাখ্যাতির নতুন সংজ্ঞা, সিনেমার শেষ ভরসা বর্ষসেরা পডকাস্টে যুদ্ধের ছায়া থেকে কৃত্রিম প্রেম, অপরাধ থেকে সংগীতের বিপ্লব আমাজনে তেলের জোয়ার, উন্নয়নের স্বপ্নে পরিবেশের দুশ্চিন্তা এআই ডেটা সেন্টারের বিস্তারে বিদ্যুৎ চাহিদা নিয়ে নতুন চাপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্থপতিরা: যে বছর চিন্তাশীল যন্ত্র মানব সভ্যতার গতিপথ বদলে দিল চিকিৎসার অগ্রগতি থামিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি, জনস্বাস্থ্যে দীর্ঘ ছায়া ভাঙা ঐকমত্যে জলবায়ু লড়াই, অর্থনীতির পথে এগোচ্ছে বিশ্ব দ্রুত ইউক্রেন শান্তিচুক্তির চাপের বিরুদ্ধে ইউরোপ

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৯ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০৫:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
  • 93
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

 

সুপ্রিয়ার ফিরতে দেরি হল। সে একেবারে হেরম্বের খাবার নিয়ে আসায় বোঝা গেল যে, শুধু অশোককে শান্ত করতেই তার এতক্ষণ সময় লাগেনি।

খাবার খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে হেরম্ব বলল, ‘তোর উপরে রাগ হচ্ছিল, সুপ্রিয়া ।”

স্বপ্রিয়া খুশী হয়ে বলল, ‘সত্যি? কখন?’

‘এই মাত্র। সিদেয় অন্ধকার দেখছিলাম।’

‘থিদেয়? আমাকে না দেখে নয়?’

হেরম্ব হাই তুলে বলল, ‘একটা বালিশ এনে দে তো, ঘুমব।’

সুপ্রিয়া একটি অত্যন্ত কুটিল প্রশ্ন করল।

‘কেন? রাত জাগেন বুঝি, ঘুমোবার সময় পান না ?’

হেরম্বও সমান কুটিলতার সঙ্গে জবাব দিল, ‘সময় পাই বই কি। রাত দশটা বাজতে না বাজতে ওখানকার সবাই, আনন্দ-সুদ্ধ, ঢুলতে ঢুলতে যে যার। ঘরে গিয়ে দরজা দেয়। তারপর সারারাত নিষ্কর্মাঘুম দিলে আমায় ঠেকায় কে!’

সুপ্রিয়া লজ্জা পেল। ‘বানিয়ে বানিয়ে এত কথা আপনি বলতে পারেন। কিন্তু আপনার শরীর যে রেটে খারাপ হয়েছে তাতে মনে হয় না ঠিকমতো আহার-নিদ্রা হয়।’

‘ রেটটা তোরও কম নয় সুপ্রিয়া।’

‘আমার অসুখ, ফিটের ব্যারাম। আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপনার।

শরীর খারাপ হবে কেন?’

‘আমারও হয়তো অসুখ, সুপ্রিয়া।’

সুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘তর্কে হারাবার উপক্রমেই অসুখ হয়ে গেল? বসুন, বালিশ এনে দিচ্ছি, ওয়াড় পরিয়ে আনতে হবে। এমন আল্ল্সে হয়েছি আজকাল, ময়লা বালিশে শুয়ে থাকি তবু ওয়াড় বদলাই না। এবার আমি মরব নাকি?’

বালিশ নিয়ে সুপ্রিয়া ফেরার আগে এল অশোক।

‘দুপুরে এখানেই খাবেন, দাদা।’

তার আমন্ত্রণের এই অমায়িক সুরে হেরম্ব বুঝাতে পারল সুপ্রিয়া সত্য সত্যই অশোককে শান্ত করতে পেরেছে। সুপ্রিয়ার এ ক্ষমতা তার অভিনব। মনে হল না। অশোকের প্রতি সুপ্রিয়ার যে গভীর ও আন্তরিক মমতা আছে, অশোকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যে নিবিড় মনোযোগ ও অক্লান্ত সেবায় তার এই মমতা প্রকাশ পায়, অশোকের অতিরিক্ত দুঃখ ও অপমান মুছে নেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। সুপ্রিয়ার প্রকৃতি শান্ত, সে বিশ্বাস করে মানুষ মাথাপাগলা নয়, বাস্তব জগতে ভাব নিয়ে মানুষের দিন কাটে না যার।

জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সে সমস্ত পাওয়া চাই। জীবন নষ্ট করবার জন্ম নয়, নিজের জন্য চাইতে এবং নিতে, যতটা পারা যায় পরকে পাইয়ে দিতে, কারো লজ্জা নেই। নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়া চাই, পরের জীবন সাজিয়ে দেওয়া চাই। হেরম্বের জন্য অশান্তি, উদ্বেগ, সন্দেহ, ঈর্ষা প্রভৃতি যতগুলি পীড়াদায়ক অনুভূতি আছে তার প্রায় সবগুলি অনুভব করে দিন কাটানোর ফলে ফিটের ব্যারাম জন্মে যাওয়া সত্ত্বেও উপরোক্ত মনোভাবের দরুন স্বপ্রিয়ার কথার ব্যবহারে সর্বদা এমন একটি কোমল ভাব ও সহানুভূতির সঙ্গে চারিদিক হিসাব করে চলবার আন্তরিক চেষ্টা প্রকাশ পায় যে, তার সম্বন্ধেও মানুষকে সে বিবেচনা করে চলতে শেখায়। সে যাকে ব্যথা দেয়, নিদারুণ ক্রোধের সময়ও তাকে স্মরণ রাখতে হয় যে উপায় থাকলে ব্যথা সে দিত না। সুপ্রিয়ার বিরুদ্ধে মনে নালিশ পুষে রাখা কঠিন।

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৮ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৮ তম কিস্তি )

জনপ্রিয় সংবাদ

খামার থেকে উৎসবের টেবিল, টার্কির নীরব দীর্ঘ পথ

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৯ তম কিস্তি )

১২:০৫:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

 

সুপ্রিয়ার ফিরতে দেরি হল। সে একেবারে হেরম্বের খাবার নিয়ে আসায় বোঝা গেল যে, শুধু অশোককে শান্ত করতেই তার এতক্ষণ সময় লাগেনি।

খাবার খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে হেরম্ব বলল, ‘তোর উপরে রাগ হচ্ছিল, সুপ্রিয়া ।”

স্বপ্রিয়া খুশী হয়ে বলল, ‘সত্যি? কখন?’

‘এই মাত্র। সিদেয় অন্ধকার দেখছিলাম।’

‘থিদেয়? আমাকে না দেখে নয়?’

হেরম্ব হাই তুলে বলল, ‘একটা বালিশ এনে দে তো, ঘুমব।’

সুপ্রিয়া একটি অত্যন্ত কুটিল প্রশ্ন করল।

‘কেন? রাত জাগেন বুঝি, ঘুমোবার সময় পান না ?’

হেরম্বও সমান কুটিলতার সঙ্গে জবাব দিল, ‘সময় পাই বই কি। রাত দশটা বাজতে না বাজতে ওখানকার সবাই, আনন্দ-সুদ্ধ, ঢুলতে ঢুলতে যে যার। ঘরে গিয়ে দরজা দেয়। তারপর সারারাত নিষ্কর্মাঘুম দিলে আমায় ঠেকায় কে!’

সুপ্রিয়া লজ্জা পেল। ‘বানিয়ে বানিয়ে এত কথা আপনি বলতে পারেন। কিন্তু আপনার শরীর যে রেটে খারাপ হয়েছে তাতে মনে হয় না ঠিকমতো আহার-নিদ্রা হয়।’

‘ রেটটা তোরও কম নয় সুপ্রিয়া।’

‘আমার অসুখ, ফিটের ব্যারাম। আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপনার।

শরীর খারাপ হবে কেন?’

‘আমারও হয়তো অসুখ, সুপ্রিয়া।’

সুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘তর্কে হারাবার উপক্রমেই অসুখ হয়ে গেল? বসুন, বালিশ এনে দিচ্ছি, ওয়াড় পরিয়ে আনতে হবে। এমন আল্ল্সে হয়েছি আজকাল, ময়লা বালিশে শুয়ে থাকি তবু ওয়াড় বদলাই না। এবার আমি মরব নাকি?’

বালিশ নিয়ে সুপ্রিয়া ফেরার আগে এল অশোক।

‘দুপুরে এখানেই খাবেন, দাদা।’

তার আমন্ত্রণের এই অমায়িক সুরে হেরম্ব বুঝাতে পারল সুপ্রিয়া সত্য সত্যই অশোককে শান্ত করতে পেরেছে। সুপ্রিয়ার এ ক্ষমতা তার অভিনব। মনে হল না। অশোকের প্রতি সুপ্রিয়ার যে গভীর ও আন্তরিক মমতা আছে, অশোকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যে নিবিড় মনোযোগ ও অক্লান্ত সেবায় তার এই মমতা প্রকাশ পায়, অশোকের অতিরিক্ত দুঃখ ও অপমান মুছে নেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। সুপ্রিয়ার প্রকৃতি শান্ত, সে বিশ্বাস করে মানুষ মাথাপাগলা নয়, বাস্তব জগতে ভাব নিয়ে মানুষের দিন কাটে না যার।

জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সে সমস্ত পাওয়া চাই। জীবন নষ্ট করবার জন্ম নয়, নিজের জন্য চাইতে এবং নিতে, যতটা পারা যায় পরকে পাইয়ে দিতে, কারো লজ্জা নেই। নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়া চাই, পরের জীবন সাজিয়ে দেওয়া চাই। হেরম্বের জন্য অশান্তি, উদ্বেগ, সন্দেহ, ঈর্ষা প্রভৃতি যতগুলি পীড়াদায়ক অনুভূতি আছে তার প্রায় সবগুলি অনুভব করে দিন কাটানোর ফলে ফিটের ব্যারাম জন্মে যাওয়া সত্ত্বেও উপরোক্ত মনোভাবের দরুন স্বপ্রিয়ার কথার ব্যবহারে সর্বদা এমন একটি কোমল ভাব ও সহানুভূতির সঙ্গে চারিদিক হিসাব করে চলবার আন্তরিক চেষ্টা প্রকাশ পায় যে, তার সম্বন্ধেও মানুষকে সে বিবেচনা করে চলতে শেখায়। সে যাকে ব্যথা দেয়, নিদারুণ ক্রোধের সময়ও তাকে স্মরণ রাখতে হয় যে উপায় থাকলে ব্যথা সে দিত না। সুপ্রিয়ার বিরুদ্ধে মনে নালিশ পুষে রাখা কঠিন।

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৮ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৮ তম কিস্তি )