মার্কিন ডলার গত দুই মাসের মধ্যে তার সেরা সপ্তাহ পার করেছে — একটি উত্থান, যেটিকে অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি পতনের মধ্যে সাময়িক পুনরুদ্ধার বলে মনে করছেন, বিশেষ করে যখন সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা সামনে রয়েছে।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, দুর্বল হয়ে পড়া ডলারের “বুল কেস” বা উত্থানের পক্ষে যুক্তি যথেষ্ট প্রভাবশালী।
গত সপ্তাহে ডলারের সামগ্রিক মান ১.৩% বেড়েছে, যার মূল কারণ ছিল জাপানে রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে ইয়েনের তীব্র পতন। তবে সেই প্রভাব বাদ দিলে ডলারের ভবিষ্যৎ তেমন উজ্জ্বল নয়।
মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ যখন সুদের হার কমাচ্ছে, তখন অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতিমালা শিথিল করা বন্ধ রেখেছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ট্রেজারি সচিব স্কট বেসেন্ট তাঁদের অর্থনৈতিক কৌশলে দুর্বল ডলারকে অন্যতম স্তম্ভ বানিয়েছেন — রপ্তানি বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং উৎপাদন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে “ডি-ডলারাইজেশন” ধারণা, যার মাধ্যমে বিশ্বের দেশগুলো ট্রাম্পের বিতর্কিত নীতির প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে। ফলে প্রশ্ন জাগে — এই পরিস্থিতিতে ডলারের পক্ষে শক্ত যুক্তি কী হতে পারে?
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বিশ্লেষণ
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের জি-১০ বৈদেশিক মুদ্রা গবেষণা বিভাগের প্রধান স্টিভেন ইংল্যান্ডার ও তাঁর দল ডলারের পতন নিয়ে আশাবাদী।
তাঁদের ধারণা, ইউরো আগামী এক বছরের মধ্যে বর্তমান ১.১৬ ডলার থেকে নেমে ১.১২ ডলারে পৌঁছাবে।
তাঁদের তত্ত্ব তিনটি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে —
১. যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী থাকবে,
২. দেশটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব বজায় রাখবে,
৩. এবং বাস্তব সুদের হার তুলনামূলকভাবে উচ্চ থাকবে।
তাঁদের এই বিশ্লেষণ যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ও প্রভাবশালী।
উৎপাদনশীলতা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়
প্রথমেই উৎপাদনশীলতা।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির গতিশীলতা ও নমনীয়তা দীর্ঘ সময় ধরে দেশটিকে অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির তুলনায় এগিয়ে রেখেছে। এখন সেই ব্যবধান আরও বাড়ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ওইসিডি’র সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছিল ১.৬% — ওইসিডি গড় ০.৬% এর চেয়ে অনেক বেশি, এবং ইউরোজোনে ০.৯% পতনের সম্পূর্ণ বিপরীত।
২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হয়েছে ৩.৩%, যা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ইংল্যান্ডার ও তাঁর সহকর্মীরা অনুমান করছেন, তৃতীয় প্রান্তিকে এটি ৫% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
তাঁরা আরও বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভবিষ্যতে এই “ট্রেন্ড প্রোডাকটিভিটি গ্রোথ” আরও বাড়তে পারে।
যদিও ওইসিডি বলছে, এখনো এআই থেকে “উল্লেখযোগ্য” উৎপাদনশীলতার সুফল পুরোপুরি দেখা যায়নি, তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, নমনীয় নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমবাজারের কারণে দেশটি এ সুফল অন্যদের তুলনায় আগে পেতে পারে।
এই সংমিশ্রণ — উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও এআই নেতৃত্ব — বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে আকর্ষণীয় করছে। তবে এটি ট্রাম্পের নিম্ন সুদের হারের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
“যদি অর্থনীতি ইতিমধ্যেই উৎপাদনশীলতা ও মুনাফার কারণে দ্রুত গতিতে চলে, তাহলে কৃত্রিমভাবে নিম্ন বাস্তব সুদের হার অর্থনীতিকে অতিরিক্ত উত্তপ্ত করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি না যে যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে টেকসইভাবে নিম্ন সুদের হার, দুর্বল ডলার এবং উচ্চ উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে পারবে।”
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতিগত বাস্তব সুদের হার বিশ্বমানের তুলনায় বেশি, এবং আক্রমণাত্মকভাবে হার না কমালে তা শিগগিরই বদলানোর সম্ভাবনা নেই।
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও “এআই বুদবুদ” বিতর্ক
তবে প্রশ্ন থেকেই যায় — যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত ঝুঁকি এবং এআই ও বিগ টেক খাতে “বুদবুদ” বা অতিমূল্যায়নের আশঙ্কা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
এই উদ্বেগগুলো যৌক্তিক হলেও এখনো নিশ্চিত নয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূলধন বেরিয়ে যেতে হলে বিনিয়োগকারীদের বিকল্প গন্তব্য দরকার — কিন্তু বর্তমানে তা খুবই সীমিত।
শিথিল রাজস্ব ও আর্থিক নীতির দিকে ঝোঁক এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়; জাপানের সাম্প্রতিক ঘটনাও তা প্রমাণ করেছে। ইয়েন বর্তমানে ইউরোর বিপরীতে রেকর্ড নিম্নে এবং ডলারের বিপরীতে ৩০ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অন্যদিকে, এআই খাতের অতিমূল্যায়ন অনেককেই ১৯৯০-এর দশকের “ডটকম বাবল”-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তবে ইউরিজন এসএলজে’র স্টিফেন জেন ও জোয়ানা ফ্রেইরের ভাষায়,
“ডটকম বাবল ২.০: আমরা এখনো বেস ক্যাম্পে।”
যদিও ট্রাম্পের হঠাৎ সিদ্ধান্ত — যেমন চীনা আমদানিতে অতিরিক্ত ১০০% শুল্ক আরোপ — বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে,
তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বাজারে বড় প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ট্রাম্প তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেন।
বিশ্ব বিনিয়োগ সম্প্রদায়ে ডলারের দুর্বলতার ধারণাই এখনো প্রধান মত।
কিন্তু বাস্তবে এটি এত সরল নয়।
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নেতৃত্ব, এবং উচ্চ বাস্তব সুদের হার — এই তিনটি উপাদান মিলিয়ে ডলারের পুনরুত্থানের পক্ষে এখন এক জোরালো ও বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি তৈরি হয়েছে।