ভূমিকা
বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি মাঝে মাঝে মানুষকে বিস্মিত করে নতুন উপহার দেয়। কখনো তা নতুন কোনো চর, কখনো আবার ছোট দ্বীপ। এই সৃষ্টির পেছনে থাকে নদীর বহমান পলি, ঝড়ের শক্তি ও সমুদ্রের স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা। এমন এক বিস্ময়ের নাম নিউ মুর আইল্যান্ড বা বাংলাদেশের প্রচলিত নাম দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ। ছোট্ট এই দ্বীপটি আয়তনে তেমন বড় না হলেও রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং জলবায়ুগত কারণে গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক গবেষক, রাজনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। দ্বীপটির আবির্ভাব ও বিলীনতার গল্প কেবল একটি ভৌগোলিক ঘটনা নয়, বরং উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রসীমা বিরোধের এক প্রতীক।
দ্বীপটির জন্ম: প্রকৃতির এক আকস্মিক উপহার
১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে বঙ্গোপসাগরে আঘাত হানে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস ও ঢেউ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর পলি সমুদ্রে ছড়িয়ে দেয়। এসব পলি জমাট বেঁধে ধীরে ধীরে পানির ওপর মাথা তোলে এক নতুন ভূমি। আন্তর্জাতিক গবেষকরা প্রথম এই দ্বীপটির অস্তিত্ব সনাক্ত করেন ১৯৭৪ সালে স্যাটেলাইট চিত্রে। কয়েক বছরের মধ্যে এটি ২.৫ থেকে ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দৃশ্যমান দ্বীপে পরিণত হয়।
প্রথম দিকে মনে করা হয়েছিল, এটি সাময়িক চর মাত্র। কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে টিকে থাকার ফলে ভূগোলবিদরা একে “নিউ মুর” নাম দেন। বাংলাদেশি গবেষকেরা একে দক্ষিণ তালপট্টি নামে আখ্যায়িত করেন।

ভৌগোলিক অবস্থান
নিউ মুর দ্বীপটির অবস্থান ছিল সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে, হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার কাছাকাছি। এটি কার্যত ভারত ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মাঝামাঝি এক সংবেদনশীল স্থানে অবস্থিত ছিল। কারণ, এই অঞ্চলের সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণ দীর্ঘদিন ধরেই দুই দেশের মধ্যে এক জটিল ইস্যু। ফলে দ্বীপটির অবস্থান ভৌগোলিক হিসাবের চেয়েও রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সামুদ্রিক সীমানার হিসাব
সমুদ্র আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের উপকূল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইইজেড (Exclusive Economic Zone) নির্ধারণ হয়। দ্বীপের অস্তিত্ব থাকলে সেই দেশের সীমানা আরও বিস্তৃত হয়। নিউ মুর দ্বীপটিকে কেন্দ্র করে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, দ্বীপটি তাদের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের দাবি ছিল, এটি তাদের উপকূলের কাছাকাছি এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বাধীন। এই দ্বীপকে ঘিরে সাগরের মাছ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল উত্তোলনের সম্ভাব্য অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়।
রাজনৈতিক বিতর্ক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
দ্বীপটি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত না ঘটলেও দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক আলোচনার বিষয় ছিল। বাংলাদেশ একে “দক্ষিণ তালপট্টি” বলে মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে, অন্যদিকে ভারত একে “নিউ মুর আইল্যান্ড” নামে নিজেদের দাবি করে। ১৯৮১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দ্বীপে পতাকা স্থাপন করে প্রতীকী দখল দেখানোর চেষ্টা করেছিল, তবে সেখানে কোনো স্থায়ী বসতি বা অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশি মৎস্যজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে মাছ ধরতে যেতেন। বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান ছিল, দ্বীপটি নদীর পলি থেকে গঠিত হওয়ায় প্রকৃতিগতভাবে এটি বাংলাদেশের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ। তবে ভারতের দাবি ছিল, এর অবস্থান তাদের সমুদ্রসীমার ভেতরেই। এই দ্বীপকে ঘিরে বৈঠক হলেও কোনো পক্ষই একে অপরের দাবিকে স্বীকার করেনি।
দ্বীপের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা
যদিও দ্বীপটি নিয়ে রাজনৈতিক দাবি প্রবল ছিল, বাস্তবে এটি মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল না। সমুদ্রের পানিতে নিয়মিত প্লাবিত হওয়া, শক্ত মাটির অভাব, মিঠা পানির ঘাটতি এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি একে টেকসই মানববসতির অযোগ্য করে তোলে। কয়েকবার গবেষকরা দ্বীপে অবতরণ করে মাটির গঠন পরীক্ষা করেন এবং সিদ্ধান্তে আসেন, এটি স্থায়ী কোনো ভূমি নয়, বরং ভঙ্গুর চর।
বিলীনতার শুরু
২০০০ সালের পর থেকে স্যাটেলাইট চিত্রে ধীরে ধীরে দেখা যেতে থাকে, দ্বীপটির আয়তন কমে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, ফলে দ্বীপটি প্রায়শই প্লাবিত হতে থাকে। এক সময় তা ধীরে ধীরে ডুবে যায়। ২০১০ সালের মার্চে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, নিউ মুর দ্বীপ আর অস্তিত্বশীল নয়। সমুদ্রের ঢেউ ও জলোচ্ছ্বাস সম্পূর্ণভাবে দ্বীপটিকে বিলীন করে দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের শিক্ষা
নিউ মুর দ্বীপের বিলীনতা বিশ্ববাসীর কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা ও হুমকি নতুন করে স্পষ্ট করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর কয়েক মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধি ছোট দ্বীপ ও চরগুলিকে সরাসরি হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ফিজি বা টুভালু মতো নিম্নভূমি দেশগুলো এ কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
নিউ মুরের মতো একটি দ্বীপের বিলীনতা এ সংকটের প্রতীকী উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল—খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার—একই পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে।
স্থানীয় প্রভাব
যদিও দ্বীপটিতে কোনো স্থায়ী বসতি ছিল না, তবুও এর অবস্থান মৎস্যশিল্পে প্রভাব ফেলেছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের মৎস্যজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে মাছ ধরতেন। দ্বীপটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় মাছ ধরার ক্ষেত্রের প্রাকৃতিক সীমানা অস্পষ্ট হয়ে যায়। এতে মৎস্যজীবীদের চলাচল ও নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন ওঠে।

ঐতিহাসিক প্রতীক
নিউ মুর দ্বীপের গল্প কেবল একটি ভৌগোলিক ঘটনা নয়, বরং উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেরও অংশ। ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সীমান্ত ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে যে টানাপোড়েন ছিল, এই দ্বীপ সেই বিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। যদিও প্রকৃতির খেয়ালে দ্বীপটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় বিতর্ক নিজে থেকেই শেষ হয়ে যায়, তবে এর অস্তিত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবসৃষ্ট সীমারেখা প্রাকৃতিক নিয়মের কাছে কতটা ক্ষণস্থায়ী।
আজ নিউ মুর দ্বীপ আর নেই। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা, ঘূর্ণিঝড় ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এটি পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। তবে এর গল্প আমাদের শেখায় তিনটি বিষয়:
প্রকৃতির শক্তির কাছে মানবদাবি দুর্বল।
জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব ও তা ভৌগোলিক মানচিত্রকেও বদলে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি কখনো কখনো এমন কিছুর জন্য সংঘাত তৈরি করে যা প্রকৃতির খেয়ালে মুহূর্তেই হারিয়ে যেতে পারে।
নিউ মুর দ্বীপ আজ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে—একটি ক্ষণস্থায়ী দ্বীপ, যা মানুষের লোভ, কূটনৈতিক টানাপোড়েন এবং প্রকৃতির অপরাজেয় শক্তির প্রতীক হয়ে থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















