১১:৩৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
 সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা তাইওয়ানের স্যাটেলাইট যুগের সূচনা: স্পেসএক্স উৎক্ষেপণে বড় অগ্রগতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৫৯) শেয়ারবাজারে টানা উত্থান, বিনিয়োগকারীদের মনোভাব আরও ইতিবাচক সিরাজগঞ্জে ব্র্যাক–ফিলিপস ফাউন্ডেশনের নতুন চার হেলথ সেন্টার প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমলেও আস্থার লড়াইয়ে এগোচ্ছে চীন কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসী নন- ওমর আব্দুল্লাহ গোপন সস রক্ষায় কঠোর নজরদারি: রেইজিং কেইনসের রহস্যময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সিআইএ–এর মূল্যায়নকে অস্বীকার করলেন ট্রাম্প ট্রাম্পের কৃষিপণ্য শুল্ক ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে পারে ভারতের রপ্তানি

বাংলাদেশের বই বিক্রি ও পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে কেন?

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণশক্তি হলো বই। একসময় বই পড়া ছিল শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মানুষের অন্যতম শখ ও চর্চা। পাঠাগারে ভিড় জমাতো তরুণরা, বইমেলায় হতো মানুষের ঢল, পরিবারে বই পড়া ছিল সম্মানের বিষয়। কিন্তু দিন দিন সেই দৃশ্য যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বই পড়া ও বই কেনার প্রবণতা ক্রমেই কমছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক এই পরিবর্তন শুধু প্রকাশনা শিল্পকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং জাতির জ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলছে।

আজকের এই প্রতিবেদনটিতে আমরা খুঁজে দেখব— কেন বই বিক্রি ও পাঠাভ্যাস কমছে, এর সামাজিক প্রভাব কী, এবং এ সমস্যার সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ডিজিটাল বিনোদনের আগ্রাসন

প্রথমেই আসা যাক প্রযুক্তির প্রসঙ্গে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে এখন স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা অনলাইন গেম—সবকিছুই তাদের সময় কেড়ে নিচ্ছে। কয়েক মিনিটের শর্ট ভিডিও কিংবা রঙিন বিনোদন বই পড়ার চেয়ে দ্রুত ও সহজ আনন্দ দেয়।

বই পড়া একটি ধৈর্যসাধ্য অভ্যাস, যেখানে সময় নিয়ে শব্দের ভেতর ডুবে যেতে হয়। কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অতি সহজ বিনোদন মানুষকে ধীরে ধীরে অধীর করে তুলেছে। ফলাফল—তরুণরা বই হাতে নেওয়ার চেয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখতেই বেশি স্বস্তি বোধ করছে।

 

পাঠাগার সংস্কৃতির অবক্ষয়

বাংলাদেশে একসময় প্রতিটি শহর ও মফস্বলে পাঠাগারের আলাদা গুরুত্ব ছিল। পাঠাগারে তরুণদের ভিড় জমত, বই পড়া হতো প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু বর্তমানে পাঠাগার সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। সরকারি ও বেসরকারি পাঠাগারগুলোতে বই হালনাগাদ হয় না, পরিকাঠামো নষ্ট, আর আধুনিকায়নের ছোঁয়া নেই।

ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠাগারের দিকে ঝুঁকছে না। যারা বই পড়তে চায় তারাও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে পাঠাগারের দুরবস্থা আরও ভয়াবহ। এই অভাব নতুন প্রজন্মকে বই থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

বইয়ের দাম বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক চাপ

বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প কাগজ ও মুদ্রণ খরচের চরম সংকটে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও মুদ্রণ ব্যয় বেড়ে গেছে। প্রকাশকদের লাভ কমে যাওয়ায় বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে।

মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বই কেনা তাদের জন্য বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু-কিশোরদের গল্পের বই থেকে শুরু করে সাহিত্যকর্ম—সবই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার চেয়ে পরীক্ষাভিত্তিক মুখস্থ পড়ার ওপর বেশি জোর দেয়। স্কুলে বা কলেজে অতিরিক্ত বই পড়ার উৎসাহ দেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বই পড়াকে পরীক্ষার বাইরে কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করে না।

একসময় স্কুলে লাইব্রেরি ক্লাস থাকত, শিক্ষকেরা বই হাতে তুলে দিতেন। এখন সেই সংস্কৃতি প্রায় হারিয়ে গেছে। পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষায় সাহিত্য, ইতিহাস বা বিজ্ঞানচর্চার বাইরের বই পড়া গুরুত্ব পাচ্ছে না, ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার বাইরের বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

সাহিত্য উৎসাহ ও সামাজিক পরিবেশের ঘাটতি

শহরকেন্দ্রিক কিছু সাহিত্য অনুষ্ঠান ও বইমেলা হলেও সেগুলো সীমিত আকারে আয়োজন হয়। গ্রামীণ বা উপজেলা পর্যায়ে বইমেলার আয়োজন নেই বললেই চলে। ফলে এক বিশাল জনগোষ্ঠী বইয়ের নাগাল পাচ্ছে না।

এ ছাড়া পরিবার ও সমাজেও বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। টেলিভিশন ও মোবাইল এখন পরিবারে প্রধান বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা-মা নিজেরাও বই পড়েন না, ফলে সন্তানদের হাতে বই তুলে দেওয়ার প্রবণতা কমেছে।

অনলাইনে দ্রুত তথ্যের সহজলভ্যতা

অতীতে গবেষণা বা জ্ঞানার্জনের জন্য মানুষ বইয়ের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের যুগে গুগল সার্চেই সহজে তথ্য পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করে বই পড়ার ঝামেলা না করে অনলাইন থেকে সংক্ষিপ্ত তথ্য জেনে নিলেই যথেষ্ট।

কিন্তু এই প্রবণতা মানুষকে তথ্যের গভীরতা থেকে বঞ্চিত করছে। বই পড়ার মাধ্যমে যে বিশ্লেষণ ক্ষমতা, ধৈর্য ও চিন্তাশক্তি তৈরি হয়, সেটি অনলাইন সার্চ দিয়ে সম্ভব নয়। তবুও সহজলভ্যতার কারণে মানুষ বইয়ের বদলে ইন্টারনেটকেই বেছে নিচ্ছে।

লেখালেখি ও প্রকাশনার মানহানি

প্রকাশনা জগতে মানসম্মত সাহিত্য বা গবেষণাধর্মী বইয়ের সংখ্যা কমছে। অনেক লেখক বাজার ধরার জন্য অল্প সময়ে বই লিখে ফেলছেন, যেখানে মৌলিক চিন্তা বা গবেষণার অভাব দেখা যায়।

অন্যদিকে, পাঠকও ভালো বই বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। বই পড়ার আগ্রহও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সমস্যার প্রভাব

১. সাহিত্যচর্চার দুর্বলতা

বই পড়া কমে গেলে সাহিত্যচর্চাও দুর্বল হয়। নতুন লেখক ও পাঠক না বাড়লে সাহিত্য অঙ্গনে স্থবিরতা নেমে আসে।

২. বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার সংকট

বই মানুষকে সমালোচনামূলক চিন্তা, বিশ্লেষণ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। বই না পড়লে তরুণ প্রজন্মের চিন্তাশক্তি সীমিত হয়ে যাবে।

৩. প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি

বই বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে প্রকাশনা শিল্প টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক প্রকাশক ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন, লেখকেরাও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

সমস্যার সমাধান ও করণীয়

পাঠাগার সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ

গ্রাম থেকে শহর—সব জায়গায় নতুন পাঠাগার স্থাপন ও পুরোনো পাঠাগার আধুনিকায়ন জরুরি। ডিজিটাল লাইব্রেরি ও অনলাইন রিডিং সিস্টেম চালু করলে তরুণরা প্রযুক্তির মাধ্যমেই বই পড়তে আগ্রহী হবে।

বইয়ের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা

সরকার প্রকাশনা শিল্পে ভর্তুকি দিতে পারে, যাতে কাগজ ও মুদ্রণ খরচ কমে যায়। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বিনামূল্যে বা কম মূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করলে পাঠাভ্যাস বাড়বে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন

পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়াকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। লাইব্রেরি ক্লাস পুনরায় চালু করা উচিত। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, বিজ্ঞানচর্চা—এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তাধারা বাড়বে।

পরিবারে বইয়ের পরিবেশ তৈরি

বাবা-মা সন্তানের হাতে বই তুলে দিতে হবে। বাড়িতে টেলিভিশন ও মোবাইলের পাশাপাশি বই পড়াকে উৎসাহিত করতে হবে।

সাহিত্য উৎসব ও প্রচারণা

শুধু রাজধানী নয়, প্রত্যন্ত এলাকায় বইমেলা আয়োজন করতে হবে। পাঠ প্রতিযোগিতা, সাহিত্যচর্চা, লেখালেখির কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে তরুণদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব।

মানসম্মত লেখালেখি ও প্রকাশনা

প্রকাশকদের উচিত মান বজায় রেখে বই প্রকাশ করা। নতুন লেখকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অভিজ্ঞ লেখকদের গবেষণামূলক বই প্রকাশে উৎসাহ দেওয়া জরুরি।

প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার

ই-বুক, অডিওবুক, অনলাইন রিডিং অ্যাপ জনপ্রিয় করতে হবে। যেহেতু তরুণরা মোবাইল ব্যবহার বেশি করছে, তাই সেই প্ল্যাটফর্মে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে।

বই বিক্রি ও পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য শুধু প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট। সমাজে জ্ঞানচর্চার ধারাকে টিকিয়ে রাখতে হলে বইয়ের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে হবে।

পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রকাশক, সাহিত্যিক, এবং সরকার—সবার যৌথ উদ্যোগে বই পড়ার সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। বই হলো মানুষের মানসিক বিকাশ ও জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। তাই বইকে আবারও জাতির হৃদয়ে ফিরিয়ে আনাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

জনপ্রিয় সংবাদ

 সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা

বাংলাদেশের বই বিক্রি ও পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে কেন?

০৮:০০:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণশক্তি হলো বই। একসময় বই পড়া ছিল শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মানুষের অন্যতম শখ ও চর্চা। পাঠাগারে ভিড় জমাতো তরুণরা, বইমেলায় হতো মানুষের ঢল, পরিবারে বই পড়া ছিল সম্মানের বিষয়। কিন্তু দিন দিন সেই দৃশ্য যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বই পড়া ও বই কেনার প্রবণতা ক্রমেই কমছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক এই পরিবর্তন শুধু প্রকাশনা শিল্পকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং জাতির জ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলছে।

আজকের এই প্রতিবেদনটিতে আমরা খুঁজে দেখব— কেন বই বিক্রি ও পাঠাভ্যাস কমছে, এর সামাজিক প্রভাব কী, এবং এ সমস্যার সমাধানে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ডিজিটাল বিনোদনের আগ্রাসন

প্রথমেই আসা যাক প্রযুক্তির প্রসঙ্গে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে এখন স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা অনলাইন গেম—সবকিছুই তাদের সময় কেড়ে নিচ্ছে। কয়েক মিনিটের শর্ট ভিডিও কিংবা রঙিন বিনোদন বই পড়ার চেয়ে দ্রুত ও সহজ আনন্দ দেয়।

বই পড়া একটি ধৈর্যসাধ্য অভ্যাস, যেখানে সময় নিয়ে শব্দের ভেতর ডুবে যেতে হয়। কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অতি সহজ বিনোদন মানুষকে ধীরে ধীরে অধীর করে তুলেছে। ফলাফল—তরুণরা বই হাতে নেওয়ার চেয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখতেই বেশি স্বস্তি বোধ করছে।

 

পাঠাগার সংস্কৃতির অবক্ষয়

বাংলাদেশে একসময় প্রতিটি শহর ও মফস্বলে পাঠাগারের আলাদা গুরুত্ব ছিল। পাঠাগারে তরুণদের ভিড় জমত, বই পড়া হতো প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু বর্তমানে পাঠাগার সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। সরকারি ও বেসরকারি পাঠাগারগুলোতে বই হালনাগাদ হয় না, পরিকাঠামো নষ্ট, আর আধুনিকায়নের ছোঁয়া নেই।

ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠাগারের দিকে ঝুঁকছে না। যারা বই পড়তে চায় তারাও নিরুৎসাহিত হচ্ছে। গ্রামীণ পর্যায়ে পাঠাগারের দুরবস্থা আরও ভয়াবহ। এই অভাব নতুন প্রজন্মকে বই থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

বইয়ের দাম বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক চাপ

বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প কাগজ ও মুদ্রণ খরচের চরম সংকটে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও মুদ্রণ ব্যয় বেড়ে গেছে। প্রকাশকদের লাভ কমে যাওয়ায় বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে।

মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বই কেনা তাদের জন্য বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু-কিশোরদের গল্পের বই থেকে শুরু করে সাহিত্যকর্ম—সবই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার চেয়ে পরীক্ষাভিত্তিক মুখস্থ পড়ার ওপর বেশি জোর দেয়। স্কুলে বা কলেজে অতিরিক্ত বই পড়ার উৎসাহ দেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বই পড়াকে পরীক্ষার বাইরে কোনো প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করে না।

একসময় স্কুলে লাইব্রেরি ক্লাস থাকত, শিক্ষকেরা বই হাতে তুলে দিতেন। এখন সেই সংস্কৃতি প্রায় হারিয়ে গেছে। পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষায় সাহিত্য, ইতিহাস বা বিজ্ঞানচর্চার বাইরের বই পড়া গুরুত্ব পাচ্ছে না, ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার বাইরের বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

সাহিত্য উৎসাহ ও সামাজিক পরিবেশের ঘাটতি

শহরকেন্দ্রিক কিছু সাহিত্য অনুষ্ঠান ও বইমেলা হলেও সেগুলো সীমিত আকারে আয়োজন হয়। গ্রামীণ বা উপজেলা পর্যায়ে বইমেলার আয়োজন নেই বললেই চলে। ফলে এক বিশাল জনগোষ্ঠী বইয়ের নাগাল পাচ্ছে না।

এ ছাড়া পরিবার ও সমাজেও বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। টেলিভিশন ও মোবাইল এখন পরিবারে প্রধান বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা-মা নিজেরাও বই পড়েন না, ফলে সন্তানদের হাতে বই তুলে দেওয়ার প্রবণতা কমেছে।

অনলাইনে দ্রুত তথ্যের সহজলভ্যতা

অতীতে গবেষণা বা জ্ঞানার্জনের জন্য মানুষ বইয়ের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের যুগে গুগল সার্চেই সহজে তথ্য পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করে বই পড়ার ঝামেলা না করে অনলাইন থেকে সংক্ষিপ্ত তথ্য জেনে নিলেই যথেষ্ট।

কিন্তু এই প্রবণতা মানুষকে তথ্যের গভীরতা থেকে বঞ্চিত করছে। বই পড়ার মাধ্যমে যে বিশ্লেষণ ক্ষমতা, ধৈর্য ও চিন্তাশক্তি তৈরি হয়, সেটি অনলাইন সার্চ দিয়ে সম্ভব নয়। তবুও সহজলভ্যতার কারণে মানুষ বইয়ের বদলে ইন্টারনেটকেই বেছে নিচ্ছে।

লেখালেখি ও প্রকাশনার মানহানি

প্রকাশনা জগতে মানসম্মত সাহিত্য বা গবেষণাধর্মী বইয়ের সংখ্যা কমছে। অনেক লেখক বাজার ধরার জন্য অল্প সময়ে বই লিখে ফেলছেন, যেখানে মৌলিক চিন্তা বা গবেষণার অভাব দেখা যায়।

অন্যদিকে, পাঠকও ভালো বই বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। বই পড়ার আগ্রহও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সমস্যার প্রভাব

১. সাহিত্যচর্চার দুর্বলতা

বই পড়া কমে গেলে সাহিত্যচর্চাও দুর্বল হয়। নতুন লেখক ও পাঠক না বাড়লে সাহিত্য অঙ্গনে স্থবিরতা নেমে আসে।

২. বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার সংকট

বই মানুষকে সমালোচনামূলক চিন্তা, বিশ্লেষণ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। বই না পড়লে তরুণ প্রজন্মের চিন্তাশক্তি সীমিত হয়ে যাবে।

৩. প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি

বই বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে প্রকাশনা শিল্প টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক প্রকাশক ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন, লেখকেরাও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

সমস্যার সমাধান ও করণীয়

পাঠাগার সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ

গ্রাম থেকে শহর—সব জায়গায় নতুন পাঠাগার স্থাপন ও পুরোনো পাঠাগার আধুনিকায়ন জরুরি। ডিজিটাল লাইব্রেরি ও অনলাইন রিডিং সিস্টেম চালু করলে তরুণরা প্রযুক্তির মাধ্যমেই বই পড়তে আগ্রহী হবে।

বইয়ের দাম নিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা

সরকার প্রকাশনা শিল্পে ভর্তুকি দিতে পারে, যাতে কাগজ ও মুদ্রণ খরচ কমে যায়। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বিনামূল্যে বা কম মূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করলে পাঠাভ্যাস বাড়বে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন

পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়াকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। লাইব্রেরি ক্লাস পুনরায় চালু করা উচিত। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, বিজ্ঞানচর্চা—এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তাধারা বাড়বে।

পরিবারে বইয়ের পরিবেশ তৈরি

বাবা-মা সন্তানের হাতে বই তুলে দিতে হবে। বাড়িতে টেলিভিশন ও মোবাইলের পাশাপাশি বই পড়াকে উৎসাহিত করতে হবে।

সাহিত্য উৎসব ও প্রচারণা

শুধু রাজধানী নয়, প্রত্যন্ত এলাকায় বইমেলা আয়োজন করতে হবে। পাঠ প্রতিযোগিতা, সাহিত্যচর্চা, লেখালেখির কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে তরুণদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা সম্ভব।

মানসম্মত লেখালেখি ও প্রকাশনা

প্রকাশকদের উচিত মান বজায় রেখে বই প্রকাশ করা। নতুন লেখকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অভিজ্ঞ লেখকদের গবেষণামূলক বই প্রকাশে উৎসাহ দেওয়া জরুরি।

প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার

ই-বুক, অডিওবুক, অনলাইন রিডিং অ্যাপ জনপ্রিয় করতে হবে। যেহেতু তরুণরা মোবাইল ব্যবহার বেশি করছে, তাই সেই প্ল্যাটফর্মে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে।

বই বিক্রি ও পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য শুধু প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতি নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট। সমাজে জ্ঞানচর্চার ধারাকে টিকিয়ে রাখতে হলে বইয়ের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে হবে।

পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রকাশক, সাহিত্যিক, এবং সরকার—সবার যৌথ উদ্যোগে বই পড়ার সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। বই হলো মানুষের মানসিক বিকাশ ও জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। তাই বইকে আবারও জাতির হৃদয়ে ফিরিয়ে আনাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।