বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড় এই ভূখণ্ডের প্রাণ। এসব নদী কেবল ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ করে না; বরং মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। ময়মনসিংহ অঞ্চলের খিরো নদীও এর ব্যতিক্রম নয়। নদীটি স্থানীয় মানুষের কাছে একদিকে জীবিকার উৎস, অন্যদিকে আবেগ ও সংস্কৃতির প্রতীক। তবে এই নদী আজ দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনার কারণে সংকটে রয়েছে। খিরোর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বোঝা তাই আজ অত্যন্ত জরুরি।
ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রবাহপথ
খিরো নদী ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া, ভালুকা ও ত্রিশালসহ একাধিক উপজেলাকে ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর উজান থেকে নেমে আসা স্রোত ধীরে ধীরে সমভূমিকে সিক্ত করে এবং কৃষিকাজে সহায়তা করে। স্থানীয়রা জানান, নদীর সঙ্গে একাধিক খাল ও উপনদী যুক্ত, যা মৌসুমভেদে প্রবাহ বাড়ায় বা কমায়। খিরো নদী আসলে ময়মনসিংহ অঞ্চলের জলপ্রবাহের একটি “ধমনী”—একে বাদ দিলে পুরো এলাকার পানিসংস্থান ও কৃষি ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
ইতিহাস ও লোককথা
খিরো নদীকে ঘিরে বহু কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, একসময় এই নদী ছিল নৌ-যাত্রার প্রধান পথ। নৌকায় করে বাজারে পণ্য আনা-নেওয়া হতো। গ্রামের মেলা বা সামাজিক অনুষ্ঠানের অনেকটাই নদীঘেঁষা এলাকায় হতো। খিরো নদীর নামকে কেন্দ্র করে একাধিক লোকগানও তৈরি হয়েছে। বর্ষাকালে খিরোর ঢেউ ছিল তরুণ-তরুণীর গান, কবিতা আর মিলনমেলার অনুপ্রেরণা। বলা যায়, নদীটি স্থানীয় সংস্কৃতির শেকড়ে মিশে আছে।

কৃষি ও অর্থনীতিতে ভূমিকা
ময়মনসিংহ জেলা কৃষিভিত্তিক এলাকা। ধান, পাট, গম, শাকসবজি ও নানা ধরনের ফসল এখানকার প্রধান উৎপাদন। খিরো নদীর পানি দীর্ঘদিন ধরে এই কৃষির প্রাণ। বিশেষ করে বোরো ও আমন মৌসুমে নদীর পানি না পেলে জমি শুকিয়ে যেত। কৃষকেরা কৃত্রিম সেচযন্ত্রের উপর অতটা নির্ভরশীল ছিলেন না; খিরোই ছিল প্রধান ভরসা।
শুধু কৃষিই নয়, মাছ ধরা এখানকার বহু পরিবারের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। একসময় খিরোর পানিতে ছিল রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, টাকি, বোয়াল, কই ইত্যাদি অসংখ্য দেশি মাছ। বাজারে এই মাছ বিক্রি করে স্থানীয় অর্থনীতি সচল থাকত। বর্ষার সময় জেলেদের নৌকাভর্তি মাছ বিক্রির দৃশ্য ছিল খিরোর নিয়মিত চিত্র।
নৌ-যোগাযোগের স্মৃতি
খিরো নদীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একসময়ের নৌ-যোগাযোগের সোনালি দিন। সড়কপথের উন্নয়নের আগে নৌকাই ছিল প্রধান যান। ত্রিশাল থেকে ফুলবাড়িয়া কিংবা ভালুকা অঞ্চলের পণ্য—ধান, গুড়, কাঠ বা গৃহস্থালির নিত্যপণ্য—সবই খিরো নদী দিয়ে আনা-নেওয়া হতো। নৌকার মাঝিদের গান ভেসে আসত সন্ধ্যায়। আজ সেই দৃশ্য নেই বললেই চলে। নদী ভরাট, প্রবাহ হ্রাস এবং আধুনিক পরিবহনের কারণে নৌ-যোগাযোগ প্রায় বিলুপ্ত।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
খিরো নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সমাজ ও সংস্কৃতির নানা দিক। বর্ষাকালে নদীর ঘাট ছিল আড্ডার কেন্দ্র। কিশোররা সাঁতার কাটত, তরুণরা নৌকায় ভ্রমণে যেত। বউঝিদের নদীতে গোসল, কাপড় কাচা, কিংবা সন্ধ্যায় কলসি ভরে পানি আনা ছিল দৈনন্দিন দৃশ্য। নদী ছিল মানুষের মেলবন্ধনের স্থান।
অন্যদিকে বৈশাখী মেলা, নৌকা বাইচ, এবং বিভিন্ন উৎসবও নদীতীরকে প্রাণবন্ত করত। গ্রামীণ লোকসাহিত্য ও গানে খিরো নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। নদীটি যেন স্থানীয়দের হৃদয়ের অংশ।

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
খিরো নদী শুধু কৃষি ও জীবিকার জন্য নয়, বরং জীববৈচিত্র্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নদীতে একসময় বিভিন্ন দেশি মাছ, জলজ উদ্ভিদ এবং তীর ঘেঁষা বৃক্ষরাজি ছিল। এটি পাখিদের জন্যও আশ্রয়স্থল হিসেবে ছিল। বিশেষ করে শীতকালে পরিযায়ী পাখি আসত খিরোর তীরে। নদীর আশপাশের সবুজ প্রকৃতি গ্রামীণ পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করত।
কিন্তু এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই বিলুপ্ত। নদীর পানি দূষিত হওয়ায় মাছের প্রজাতি কমে গেছে। অতিরিক্ত বালু উত্তোলন এবং দখলের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
বর্তমান সংকট
আজ খিরো নদী নানা সমস্যায় জর্জরিত।
দখল: নদীর দুই তীরে অবৈধ দখল বেড়েছে। বসতি, দোকানপাট, এমনকি বাজার বসানো হচ্ছে। এতে নদীর প্রস্থ কমে যাচ্ছে।
দূষণ: শিল্পকারখানার বর্জ্য ও গৃহস্থালির ময়লা সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে পানি কৃষিকাজের জন্যও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠছে।
পলি জমে নদী ভরাট: নিয়মিত খনন না হওয়ায় নদী পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, আবার শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
মানুষের জীবনে প্রভাব
খিরো নদীর সংকট সরাসরি মানুষের জীবনে আঘাত হেনেছে। কৃষকেরা এখন সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। এতে খরচ বাড়ছে, লাভ কমছে। জেলেরা মাছের অভাবে পেশা বদল করছেন। অনেক পরিবার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরও সংকুচিত হয়েছে। যে নদী একসময় ছিল মানুষের মিলনস্থল, আজ তা অনেকাংশে পরিত্যক্ত।

পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা
তবে খিরো নদীকে রক্ষা করা অসম্ভব নয়। কিছু পদক্ষেপ নিলে নদী আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে:
- খনন কার্যক্রম:নিয়মিত ড্রেজিং করে নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার করতে হবে।
- দখলমুক্তকরণ কার্যক্রম:নদীর দুই তীর থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ জরুরি।
- দূষণ নিয়ন্ত্রণ:শিল্পবর্জ্য ও গৃহস্থালির ময়লা নদীতে ফেলার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
- সবুজায়ন:নদীতীরে বৃক্ষরোপণ করে জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
- সচেতনতা বৃদ্ধি:স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে যেন তারা নিজেরাই নদীর অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে।
খিরো নদী ময়মনসিংহের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নদী মানে শুধু পানি নয়—এটি মানুষের আবেগ, জীবিকা, স্মৃতি ও পরিচয়ের অংশ। একসময় এই নদী স্থানীয় অর্থনীতির মূলধারা ছিল, সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। আজ সেটি সংকটে পড়লেও সঠিক পদক্ষেপ নিলে খিরো আবারও সেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেতে পারে।
খিরো নদীকে রক্ষা করা মানে কেবল একটি জলাধারকে রক্ষা করা নয়—বরং একটি অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা। তাই এখনই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















