মোদির চীন সফর এবং পরিবর্তিত সম্পর্ক
সাত বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবার চীনের মাটিতে পা রাখছেন। ৩১ আগস্ট তিনি বেইজিং থেকে দুই ঘণ্টার দূরত্বে তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) বৈঠকে যোগ দেবেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় বরফে জমে ছিল, এবার সেই পরিস্থিতি কিছুটা গলছে। তবে মোদির মাথায় রয়েছে আরেকটি বড় চিন্তা—আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ক্রমশ খারাপ হতে থাকা সম্পর্ক।
ট্রাম্পের দ্বৈরথ: পাকিস্তান ও বাণিজ্যে আঘাত
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতকে দুবার অপমান করেছেন। প্রথমে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে, পরে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়ে। ফলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত কখনও একক শক্তির সঙ্গে পূর্ণ জোট বাঁধেনি, বরং ‘বহুমুখী সম্পর্ক’ বজায় রেখেছে। তবুও গত ২৫ বছরে ভারত মূলত পশ্চিমমুখী ছিল।

আমেরিকার সঙ্গে পুরোনো ঘনিষ্ঠতা
২০০১ সালে আমেরিকা ভারতের ওপর পারমাণবিক কর্মসূচি-সংশ্লিষ্ট নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ২০০৫ সালে শুরু হওয়া পারমাণবিক চুক্তি ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৬ সালে আমেরিকা ভারতকে ‘মেজর ডিফেন্স পার্টনার’ ঘোষণা করে, যাতে ভারত উন্নত সামরিক প্রযুক্তি পায়। এসবই মূলত চীনকে ঠেকানোর কৌশল ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের হঠাৎ অবস্থান পাল্টানো ভারতীয়দের মধ্যে নতুন সন্দেহ জাগিয়েছে।
নতুন বাণিজ্য যুদ্ধ
এপ্রিল মাসে ট্রাম্প সব দেশকে শুল্কের হুমকি দিলেও আশা ছিল ভারত প্রথমেই সমঝোতায় পৌঁছাবে। কিন্তু কৃষিখাতে বিদেশি কোম্পানি ঢুকতে দেবে না—এই অবস্থানে ভারত অনড় থাকে। জুলাইয়ে আমেরিকা ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করে, যা আগস্টে আবার দ্বিগুণ করা হয়। ফলে ভারত এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ শুল্কপ্রাপ্ত দেশগুলোর একটি।
তবে ভারতের অর্থনীতি পণ্য রপ্তানির ওপর ততটা নির্ভরশীল নয়—জিডিপির মাত্র ১১%। তাই স্বল্পমেয়াদে বড় ক্ষতি হবে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীল শিল্প ও বিদেশি বিনিয়োগ টেনে আনার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।
সেবা খাতের ঝুঁকি
ভারতের সফটওয়্যার ও আর্থিক সেবাখাত দ্রুত বাড়ছে। এ খাত এখনো শুল্কযুদ্ধে জড়ায়নি, কিন্তু ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আমেরিকা ভারতের অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী। বড় মার্কিন কোম্পানিগুলো ভারতে কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত হলে বড় ধাক্কা আসবে।

প্রতিরক্ষা ও পাকিস্তান ইস্যুতে বিভাজন
মে মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সংঘাত শুরু হলে আমেরিকা প্রথমে ভারতকে সমর্থন করে। পরে আবার দুই পক্ষকে সমানভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া বন্ধ করতে বলে। এতে ভারত ক্ষুব্ধ হয়। ট্রাম্প এরপর দাবি করেন, তিনি উভয় পক্ষকে বাণিজ্য অবরোধের হুমকি দিয়ে শান্তি স্থাপন করেছেন। এমনকি কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন, যা ভারত বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
অবস্থা আরও জটিল হয় যখন ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে আপ্যায়ন করেন এবং পাকিস্তানের জ্বালানি খাতকে সাহায্য করার ঘোষণা দেন। এতে ভারতের সামরিক পরিকল্পনাকারীরা গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
মার্কিন-ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের টানাপোড়েন
গত চার বছরে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের অস্ত্র কেনা কমেছে। আমেরিকার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার হওয়ার কথা ছিল। কোয়াড জোটে (আমেরিকা, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) যৌথ মহড়া থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান ইঞ্জিন তৈরিতে সহযোগিতার চুক্তিও চলছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের অস্থির নীতি এসবকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ভারতের সম্ভাব্য কৌশল
ভারতের প্রতিক্রিয়া তিন দিক থেকে আসতে পারে—
ট্রাম্পের সঙ্গে আপস খোঁজা:
ভারত শুল্কের পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি। বরং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে মোদির ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা হতে পারে।

বিকল্প বন্ধু খোঁজা:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার উদ্যোগ চলছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করা:
সীমান্ত সমস্যার সমাধান আংশিকভাবে হওয়ার পর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। ভারতীয় শিল্পে চীনা প্রযুক্তি ও উপকরণ গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিনিয়োগে কিছুটা শিথিলতা আনার সম্ভাবনা আছে।
সংস্কার ও অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি
ভারতের আরেকটি বিকল্প হলো ঘরোয়া সংস্কার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমেরিকার শুল্কনীতির ধাক্কা সামাল দিতে হলে ভারতের উচিত নতুন অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করা। শিল্প ও প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতা বাড়ানো ছাড়া বিশ্বে মর্যাদা অর্জন সম্ভব নয়।
এখন ভারতের অবস্থা এমন যে, বিদেশি রাজধানীগুলোর সিদ্ধান্তে দেশটি প্রভাবিত হচ্ছে। তবে এই সংকটই ভারতের জন্য সুযোগ হতে পারে—অর্থনৈতিক সংস্কার ও কৌশলগত নতুন ভারসাম্য গড়ে তোলার। সময় যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আর ভারতকে সহজে কোণঠাসা করতে পারবে না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















