ভারতের বর্তমান সংকট
ভারত আজ একইসঙ্গে অপমান, আত্মপ্রত্যয় এবং এক ঐতিহাসিক পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষের পর ইসলামাবাদকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন এবং এবার ভারতকে চীনের চেয়েও বেশি শুল্কের মুখে ফেলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ও পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির প্রতিক্রিয়া তিনি কতটা ভেবেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি আত্মনির্ভর ও শক্তিশালী ভারতের পথরেখা ঘোষণা করেছেন। তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেণ, যদিও চার বছর ধরে হিমালয়ে দুই দেশের সেনারা মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এক ভয়ানক কৌশলগত ভুল। তবে ভারতের কাছে এটি একইসঙ্গে এক সুযোগ—বিশ্বশক্তি হওয়ার দাবির প্রথম বড় পরীক্ষা।

দ্বিগুণ অপমান
২৭ আগস্ট ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের উপর বাড়তি ২৫% শুল্ক আরোপ করেছে, যা আগের ২৫% আমদানি শুল্কের উপর চাপানো হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে রাশিয়ার তেল কেনা। অথচ ভারত পশ্চিমাদের অনুমোদিত মূল্যসীমা পদ্ধতিতে তেল কিনছে এবং ইউরোপকে পরিশোধিত জ্বালানি রপ্তানি করছে। একইসঙ্গে চীনসহ বহু দেশ রাশিয়ার তেল কিনছে। ফলে ভারতকে বিশেষভাবে শাস্তি দেওয়ার বার্তা স্পষ্ট।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য আরেক বড় আঘাত। মে মাসে সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের মধ্যে চার দিনের সীমান্ত সংঘর্ষে শতাধিক যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এবং পারমাণবিক সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। অথচ ট্রাম্প এখন পাকিস্তানে খনিজ ও ক্রিপ্টো খাতে ব্যবসায়িক চুক্তি খুঁজছেন। আরও এগিয়ে গিয়ে তিনি হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিফ মুনীরকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যিনি ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রস্তাব দিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব থেকে, যা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার নিজস্ব নীতি ও ভারতের জন্য এক অনড় নিষেধ ছিল।

আমেরিকার কৌশলগত ভুল
ভারতের জন্য কোর নিরাপত্তা ইস্যুতে সমর্থন না দেওয়া এবং বাণিজ্যে শাস্তি দেওয়া ভারতীয়দের আস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা ভারতকে এশিয়ায় চীনের আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী এক গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ভারতের ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ও ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের শেয়ারবাজার পাকিস্তানের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী। তাই এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার জন্য আত্মঘাতী এবং ইউরোপে ন্যাটোর প্রতি অবহেলার মতোই ক্ষতিকর।
ভারতের আত্মপ্রত্যয়ের অনুভূতি
স্বাধীনতার পর থেকে ভারত কখনও আনুষ্ঠানিক জোটে যোগ দেয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে নাম পরিবর্তন করে “নিরপেক্ষ” থেকে “বহুমুখী মৈত্রী”-তে রূপ নিয়েছে। অস্ত্রের ক্ষেত্রে রাশিয়া, ইউরোপ, ইসরায়েল ও আমেরিকার উপর নির্ভর করে। উৎপাদন সামগ্রী আসে চীন থেকে, প্রযুক্তি ও বাজার পায় পশ্চিম থেকে।
২০২০ সালে হিমালয়ের সংঘর্ষের পর ভারত-চীন সম্পর্ক জমে গেলে ওয়াশিংটনে অনেকে আশা করেছিলেন, ভারত হয়তো আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র হবে। যৌথ সামরিক মহড়া ও ২০২৪ সালের প্রতিরক্ষা চুক্তি সেই ধারণা আরও জোরালো করে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ভারতের সন্দেহবাদীদের আত্মপ্রত্যয়ী করেছে—আমেরিকার উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বিপজ্জনক। তাই মোদির চীন সফর এই বার্তাই দিচ্ছে যে ভারতের বিকল্প আছে।

ভারতের শক্তি ও দুর্বলতা
১১ বছর ধরে মোদি দেশকে আধুনিকীকরণ ও কেন্দ্রীকরণের পথে নিয়ে গেছেন। যদিও শিল্পায়নে চাকরি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম, শিক্ষা খাত দুর্বল এবং কখনও কখনও তিনি হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদে ভেসে যান। তবে সফলতাও আছে—নতুন সড়ক, বিমানবন্দর, ডিজিটাল পেমেন্ট ও কর ব্যবস্থা এক বিশাল একক বাজার তৈরি করেছে। আর্থিক ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি কম, ব্যাংক স্থিতিশীল।
ভারত “চায়না প্লাস ওয়ান” সরবরাহ চেইন থেকে হয়তো তেমন লাভ পাবে না, কিন্তু তার অর্থনীতি ৬% এর বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৮ সালের মধ্যে আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ভারত হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তবে আমেরিকার আগ্রাসী নীতি যদি ভারতে আত্মকেন্দ্রিকতা ও পশ্চিমবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলে, তবে এর বড় ক্ষতি হবে। ভারতের সেবা খাতের অর্ধেক আয় আসে আমেরিকান গ্রাহকদের কাছ থেকে এবং শিল্পায়নে দ্রুত অগ্রসর হতে চীনা যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল প্রয়োজন।
করণীয়: ভারসাম্যের পথে ভারত
ভারতের উচিত ক্ষতি সীমিত রাখা। যুক্তিসঙ্গত ছাড় দিতে হবে—যেমন আমদানি শুল্ক কমানো, রাশিয়ার তেল কম কেনা এবং আমেরিকান প্রাকৃতিক গ্যাসের দিকে ঝোঁকা। ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের শক্ত ভিত্তি এখনো আছে, বিশেষত প্রবাসী ভারতীয়দের কারণে। একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও বাড়াতে হবে, কারণ শিল্প উন্নয়নের জন্য তা অপরিহার্য।
মোদি ইতিমধ্যেই ব্রিটেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করেছেন। আগামীতে আরও নতুন চুক্তি করা দরকার।

অভ্যন্তরীণ সংস্কারের গুরুত্ব
ভারতের ভাগ্য হচ্ছে স্বাধীন থাকা। বৃহৎ জনসংখ্যা ও গতিশীলতা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিদেশি চাপের মুখেও অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা, আদালত সংস্কার, কৃষি, ভূমি ও বিদ্যুৎ খাত আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
অনেক সংস্কার কেন্দ্র ও রাজ্যের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। মোদি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি জিএসটি সহজ করবেন এবং অর্থনীতিকে আরও মুক্ত করবেন—যা তিনি “নেক্সট জেন সংস্কার” নামে উল্লেখ করেছেন। ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এখন তার দ্রুত ও বড় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ভারতের গভীরতম অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা শুধু জাতীয় স্বার্থই নয়, বরং শত্রুভাবাপন্ন আন্তর্জাতিক পরিসরে এটিই হবে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















