পরিচিতি
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত রত্নগুল জলাবন বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবন। প্রায় ৩,৩২৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই বনভূমি বর্ষাকালে নদী ও খালের জলে তলিয়ে যায়। বছরের সাত মাসের বেশি সময় পানি গাছের কাণ্ড ঢেকে রাখে। তখন বনটি ভেসে ওঠে এক অনন্য সৌন্দর্যে। স্বচ্ছ সবুজ পানি, পানির মধ্যে দাঁড়ানো করচ আর হিজল গাছ এবং তাদের ডালে ঝুলে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি—সব মিলে রাতারগুল যেন এক জীবন্ত রূপকথা।
বৃক্ষরাজি ও সবুজের সমারোহ
রাতারগুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর পানিবান্ধব বৃক্ষ। এখানে সর্বাধিক দেখা যায় করচ গাছ (Barringtonia acutangula), যেগুলো বছরের পর বছর পানির ভেতরে দাঁড়িয়ে থেকেও সবুজ ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। করচের পাশাপাশি হিজল (Barringtonia racemosa), কদম (Neolamarckia cadamba), জলপাই, গুটিজাম, বনকচু ও বেতগাছও প্রচুর জন্মেছে। বর্ষার সময় কদম ফুল ফুটে যখন চারপাশ ভরে যায়, তখন বনটি যেন এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
এই বনে কেবল গাছপালা নয়, বরং লতাগুল্ম ও ঝোপঝাড়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বেতের ঝোপ বনের ভেতরে প্রাকৃতিক প্রাচীর তৈরি করে, যা অনেক প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে।

ঘাস, ঝোপঝাড় ও জলজ উদ্ভিদ
রাতারগুলে নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ জন্মে। বর্ষায় পানির উপরে শাপলা, শালুক, পদ্মফুল ও বিভিন্ন ধরনের সরু ঘাস কার্পেটের মতো ভেসে থাকে। শাপলার পাতা ও ফুলের ভেতরে পোকামাকড় আশ্রয় নেয়, আবার হাঁসের মতো পাখিরা খাদ্য সংগ্রহ করে।
বর্ষায় প্রচুর জন্মায় কচুরিপানা। এটি একদিকে পাখি ও মাছের খাদ্যের উৎস, অন্যদিকে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। শীতে যখন পানি নেমে যায়, তখন শুকনো জমিতে ঝোপঝাড় ও নানান ঘাস জন্মায়। এগুলো গরু-ছাগলের খাদ্য হলেও একই সঙ্গে কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থল।
স্তন্যপায়ী প্রাণী
রাতারগুলে স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি এখানে টিকে আছে।
- রিসাস বানর (Rhesus macaque) – দলে দলে গাছে গাছে লাফালাফি করে, প্রায়শই পর্যটকদের খাবার কেড়ে নেয়।
- শিয়াল – নিশাচর প্রাণী, রাতে বনজুড়ে খাদ্য সংগ্রহ করে।
- উদবিড়াল (Otter) – পানিতে মাছ শিকার করে, আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ।
- বন্য বিড়াল – গোপন স্বভাবে শিকার করে, তবে সাধারণত মানুষের চোখে কম পড়ে।

পাখির অভয়ারণ্য
রাতারগুল আসলে পাখিদের স্বর্গরাজ্য। এখানে সারাবছর প্রায় ৫০টির মতো প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তবে শীতে যখন সাইবেরিয়া ও উত্তর এশিয়া থেকে অতিথি পাখিরা আসে, তখন রত্নগুল পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
দেশীয় পাখির মধ্যে দেখা যায়—সাদা বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বালিহাঁস, খয়রা পেঁচা।
শীতকালে অতিথি পাখির মধ্যে আসে—চখাচখি, পাতি সরালি, ভূতিহাঁস, নানা প্রকার রাজহাঁস।
পাখিদের আচরণও বৈচিত্র্যময়। কেউ পানির নিচে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কেউ পোকামাকড় খেয়ে বাস্তুতন্ত্রকে ভারসাম্যে রাখে। অনেকে আবার উঁচু গাছে বিশ্রাম নেয় বা দল বেঁধে ভ্রমণ করে।
সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী
রাতারগুলে সরীসৃপের মধ্যে জলসাপ ও গোখরা দেখা যায়। এরা পানির ভেতর বা বনের ভেতরে শিকার করে। এ ছাড়া এখানে কচ্ছপ পাওয়া যায়, যারা পানিতে উদ্ভিদ ও ছোট প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে।
উভচরের মধ্যে ব্যাঙ সবচেয়ে সাধারণ। বর্ষার রাতে তাদের ডাক বনভূমি মুখরিত করে তোলে, যা পরিবেশের জন্য এক প্রাকৃতিক সুর।

মাছ ও জলজ প্রাণী
গোয়াইন নদী এবং খাল-বিলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে রত্নগুল মাছের ভাণ্ডার। এখানে অন্তত ২০টির বেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
দেশীয় প্রজাতির মধ্যে রয়েছে—রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, বোয়াল, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া।
মাছের সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুক, কাঁকড়া ও নানা প্রজাতির জলজ শামুকও প্রচুর রয়েছে। এগুলো স্থানীয় মানুষের জীবিকা ও খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
কীটপতঙ্গ ও ক্ষুদ্র প্রাণী
রাতারগুলের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম স্তম্ভ হলো এর কীটপতঙ্গ। এখানে প্রজাপতি, মৌমাছি, ফড়িং, মশা, গুবরে পোকা ইত্যাদি বাস করে।
মৌমাছি ও প্রজাপতি ফুলের পরাগায়ণ ঘটায়, ফলে নতুন গাছ জন্মে। আবার মশা ও অন্যান্য ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ অনেক সময় পাখি ও ব্যাঙের খাদ্য হয়। এভাবে ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গও বাস্তুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখে।

বাস্তুতন্ত্রের আন্তঃসম্পর্ক
রাতারগুলের প্রতিটি জীব একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
- বানর ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয়, যা নতুন গাছ জন্মাতে সাহায্য করে।
- পাখি কীটপতঙ্গ খেয়ে সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণ আনে।
- মাছ পানির জৈবিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
- ব্যাঙ ও সরীসৃপ ছোট প্রাণী খেয়ে খাদ্যচক্র বজায় রাখে।
এভাবে রাতারগুলের প্রতিটি গাছ, প্রাণী ও কীটপতঙ্গ একসঙ্গে একটি জীবন্ত বাস্তুতন্ত্র তৈরি করেছে।
রাতারগুল কেবল একটি প্রাকৃতিক বন নয়, এটি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের এক মহামূল্যবান সম্পদ। এখানকার গাছ, ঝোপ, ঘাস, পাখি, প্রাণী, মাছ ও ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ মিলেই গড়ে তুলেছে এক স্বর্গীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই জলাবনকে রক্ষা করা জরুরি, কারণ রত্নগুলকে হারানো মানে কেবল একটি বন হারানো নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীববৈচিত্র্যময় জগত হারানো।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















