ভৌগোলিক পরিচয় ও অবস্থান
বাংলাদেশের ভোলা জেলার চর ফ্যাশন উপজেলার সর্বদক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জন্ম নিয়েছে চর কুকরিমুকরি দ্বীপ। ভৌগোলিকভাবে এটি এক অনন্য চর, যার চারপাশে মেঘনা নদী, তেঁতুলিয়া নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি বেষ্টন করে আছে। সাগর ও নদীর জোয়ার-ভাটার চক্র, ভাঙন ও পলির সঞ্চয়ে দ্বীপটি ক্রমাগত গড়ে উঠেছে এবং সময়ক্রমে রূপ পরিবর্তন করছে। এ কারণে চর কুকরিমুকরি শুধুমাত্র একটি দ্বীপ নয়, বরং বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূগোলের জীবন্ত দলিল।
ইতিহাস ও নামকরণ
চর কুকরিমুকরির নামকরণ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা কাহিনি প্রচলিত। লোকমুখে শোনা যায়,“কুকরি” ও “মুকরি” ছিল দুই বোনের নাম, তাদের নাম থেকেই দ্বীপটির নাম এসেছে। আরেক মতে, এখানে একসময় কুকরি ও মুকরি নামের গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মাত, সেখান থেকেও নামের উৎপত্তি হতে পারে। ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে বসতি গড়ে উঠতে থাকে। প্রথমে জেলে ও কৃষক পরিবার এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। মাছ ধরা, কৃষিকাজ ও লবণ উৎপাদন ছিল প্রাথমিক জীবিকার উৎস। সময়ের সাথে সাথে এই দ্বীপ মানুষের জীবন ও সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

জনবসতি ও সমাজজীবন
প্রথমদিকে দ্বীপে কয়েকটি পরিবার বসবাস শুরু করলেও ধীরে ধীরে বসতি বিস্তৃত হয়। বর্তমানে এখানে কয়েক হাজার মানুষ বসবাস করছে। সমাজজীবন মূলত সহজ-সরল গ্রামীণ ধারায় গড়ে উঠেছে। মাটির ঘর, বাঁশের বেড়া, খেজুরগাছের ছায়া, পুকুর ও ছোট খালের চারপাশে মানুষের বসতি ছড়িয়ে আছে। দ্বীপের মানুষ পরিশ্রমী ও সংগ্রামী। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো সীমিত হলেও স্থানীয়রা নিজেদের প্রচেষ্টায় জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের শিক্ষার জন্য কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রায় নেই। স্বাস্থ্যসেবার জন্য ছোট ডিসপেনসারি আছে, তবে জরুরি চিকিৎসায় দ্বীপবাসীদের মূল ভূখণ্ডে যেতে হয়।
অর্থনীতি ও জীবিকা
চর কুকরিমুকরির অর্থনীতি মূলত মাছ ধরা ও কৃষিকাজ নির্ভর। বঙ্গোপসাগরে প্রতিদিন শত শত নৌকা মাছ ধরতে যায়। ইলিশ, চিংড়ি কোরালসহ নানা প্রজাতির মাছ এখানকার প্রধান সম্পদ। কৃষিজমিতে ধান, শাকসবজি, মরিচ, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া উৎপাদিত হয়। একসময় লবণ চাষও দ্বীপের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। নারকেল ও সুপারির বাগান এখানকার বিশেষ সম্পদ। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটনশিল্পের বিকাশ স্থানীয়দের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। স্থানীয়রা পর্যটকদের জন্য দোকানপাট, খাবারের দোকান ও কটেজ তৈরি করছে। তবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সবসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সৈকত
চর কুকরিমুকরির সমুদ্রতট দ্বীপটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত সোনালি বালুর সৈকত, শান্ত নীল সমুদ্র আর দিগন্তজোড়া আকাশ একে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য বিশেষভাবে দর্শনীয়। ঢেউ তুলনামূলকভাবে শান্ত, তবে বর্ষাকালে সমুদ্র ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। সৈকতের পাশে বিস্তৃত কেওড়া ও সুন্দরী বনের সবুজ সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ। এ কারণে অনেকে একে “দ্বিতীয় কক্সবাজার” বলেও অভিহিত করে থাকেন।
জীববৈচিত্র্য ও বনভূমি
চর কুকরিমুকরি জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাণ্ডার। এখানে প্রায় ২০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। দ্বীপে হরিণ, বনবিড়াল, শিয়াল, খরগোশসহ বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস রয়েছে। তাছাড়া ম্যানগ্রোভ বনের সমৃদ্ধ গাছপালার মধ্যে সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া ও গোলপাতা উল্লেখযোগ্য। এসব গাছ শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, দ্বীপকে ভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস থেকেও রক্ষা করে।

পরিযায়ী পাখি ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
প্রতি বছর শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এখানে আশ্রয় নেয়। রাশিয়া, সাইবেরিয়া ও হিমালয় অঞ্চল থেকে আসা এসব পাখির মধ্যে বক, কাঁকড়া খেকো বক, নানা প্রজাতির হাঁস, রাজহাঁস এবং জলচর পাখি উল্লেখযোগ্য। তখন পুরো দ্বীপ পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে। এ কারণে চর কুকরিমুকরি আন্তর্জাতিকভাবে পাখিবিজ্ঞানী ও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
পরিবেশগত সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তন
দ্বীপটির ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙন এখানে বারবার আঘাত হানে। ঘরবাড়ি ভেসে যায়, কৃষিজমি লোনা পানিতে ডুবে যায়, মানুষ আশ্রয় হারায়। ম্যানগ্রোভ বন নির্বিচারে কেটে ফেলার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে চর কুকরিমুকরি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

পর্যটন সম্ভাবনা
চর কুকরিমুকরি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনাময় স্থান। প্রাকৃতিক সৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, হরিণের দল এবং হাজার হাজার পাখির ঝাঁক পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম। সাম্প্রতিক সময়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণা বেড়েছে। তবে পর্যটন অবকাঠামো এখনও সীমিত। সঠিক পরিকল্পনা ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন করলে এটি কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনের মতো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
চর কুকরিমুকরি শুধু একটি দ্বীপ নয়, এটি বাংলাদেশের প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও উপকূলীয় জীবনযাত্রার প্রতীক। দ্বীপটিকে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে। যথাযথ অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যটন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক মর্যাদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলা করে এই দ্বীপকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা সময়ের দাবি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















