আগস্ট ২০২৫-এ বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ মাত্রা পেয়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর মাসিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সাংবাদিক হত্যা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং মব সহিংসতার মতো উদ্বেগজনক তথ্য। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার, সীমান্ত হত্যা ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
সাংবাদিক হত্যা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকটে
আগস্ট মাসে একজন সাংবাদিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ফেনীতে আরও পাঁচ সাংবাদিককে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্তত ১১ জন সাংবাদিক হামলায় আহত এবং ৪৫ জন হুমকির মুখে পড়েছেন। এছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করে ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। দুই সাংবাদিককে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে ভয়াবহভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য বড় হুমকি।

সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা
আগস্টে সংখ্যালঘুদের উপর অন্তত ১০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বাড়িঘর ভাঙচুর, জমি দখল, ধর্ষণ ও ধর্মীয় কারণে গ্রেফতারের মতো অভিযোগ রয়েছে এসব ঘটনায়। সনাতন ধর্মাবলম্বী ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা ভয় ও হয়রানির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়াচ্ছে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে।
মব সহিংসতা ও গণপিটুনি
আগস্টে অন্তত ৩৮টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যাতে ২৩ জন নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ উপস্থিত থেকেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই প্রবণতা সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দিচ্ছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এই সহিংসতাকে উৎসাহিত করছে, যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, মব সহিংসতা রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা বয়ে আনতে পারে।

রাজনৈতিক সহিংসতা
আগস্টে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনায় অন্তত ৫৪৯ জন আহত এবং দুইজন নিহত হয়েছেন। বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দুর্বৃত্তদের হামলায় আরও হতাহতের ঘটনা বেড়েছে।
ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বাড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার
খাগড়াছড়িতে সেনা অভিযানের সময় এক ব্যক্তি ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। কুষ্টিয়ায় মাদকবিরোধী অভিযানে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হন। চট্টগ্রামে পুলিশ পরিচয়ে এক কিশোরকে অপহরণ করা হয়। থানায় হেফাজতে আত্মহত্যা ও আদালতের রায় ঘোষণার পর আসামির মৃত্যু ঘটেছে। পুলিশি নির্যাতনে আরও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এমএসএফ বলছে, এসব ঘটনা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করছে।

সীমান্তে অস্থিতিশীলতা
সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুইজন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। ভারতীয় নাগরিকদের হাতে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন। মিয়ানমারে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন দুজন। আরাকান আর্মি ৫১ জন বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া অন্তত ৩৩১ জনকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, সীমান্তবর্তী মানুষ এখন আতঙ্কে জীবন কাটাচ্ছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন
আগস্টে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৩৪৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৭টি ধর্ষণ, ১৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং চারটি ধর্ষণের পর হত্যা। একই মাসে ৪১ জন নারী ও কিশোরী আত্মহত্যা করেছেন এবং ৭৫ জন নারী ও শিশু খুন হয়েছেন।
কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বলছে—
- • সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
- • মব সহিংসতা ও গণপিটুনি রোধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
- • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
- • সীমান্তে হত্যারোধে কূটনৈতিক উদ্যোগ জরুরি।
- • নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সংস্থাটি সতর্ক করেছে, মানবাধিকার সুরক্ষা ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















