বাংলার ভোজের গৌরব হিসেবে পরিচিত ইলিশ এখন খুলনার বাজারে বিলাসবহুল এক পণ্য হয়ে উঠেছে। মৌসুম থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই, ফলে দাম বেড়ে গেছে হু হু করে। এতে ব্যবসায়ীরা হতাশ আর সাধারণ ক্রেতারা বাজার থেকে একেবারেই দূরে সরে গেছেন।
খুলনার প্রধান পাইকারি মাছের আড়ত—ভৈরব নদীর ঘাট নম্বর ৫ ও রূপসা ফিশ ঘাট, যা ‘ইলিশ ঘাট’ নামে পরিচিত— এ গিয়ে দেখা গেছে আগের মতো ঝুড়ি ভরা মাছের জৌলুস নেই। একসময় যেখানে ঝলমলে ইলিশের সারি থাকত, এখন সেখানে ফাঁকা ট্রে।
প্রজন্মজুড়ে ব্যবসা, তবু অচেনা সংকট
পাইকারি ব্যবসায়ী সাঈদ আলী বলেন, “আমার বাবা-দাদা এই ব্যবসায় ছিলেন। প্রায় ৭০–৮০ বছর ধরে আমাদের পরিবার ইলিশ বিক্রি করছে। কিন্তু এই মৌসুমের মতো এমন সংকট কখনও দেখিনি। সাধারণত খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি, কিন্তু এ বছরের দাম এত বেড়েছে যে অনেকে অন্য মাছের ব্যবসায় চলে গেছেন।”

জেলে গ্রেপ্তার, ভোক্তার হতাশা
ইলিশ ধরা নিষেধাজ্ঞা ভেঙে মাছ ধরায় ১৬৫ জন জেলে কারাগারে আছেন। অন্যদিকে সাধারণ ভোক্তার কাছে এই মাছ এখন স্বপ্নের মতো দূরের বিষয়।
খুলনার নিউ মার্কেট কিচেন মার্কেটের ৬০ বছরের রিকশাচালক জালাল বলেন, “দোকানে সাজানো মাছ শুধু দেখার জন্য রাখা হয়, আমাদের কেনার সাধ্য নেই। দুই বছর আগে মেয়ের অনুরোধে ৫৫০ টাকা দিয়ে চারটা ছোট ইলিশ কিনেছিলাম। তারপর আর কেনা হয়নি। এখন শুধু বাজারে গিয়ে দূর থেকে দেখি, অন্যের কথা শুনি।”
তিনি আরও বলেন, “সারাদিন রিকশা চালিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালাতে হয়। বাসাভাড়া, বাজার, মেয়েদের ও ছেলের খরচ—মৌলিক জিনিসই জোগানো কঠিন। ইলিশ কেনার কথা ভাবতেই পারি না।”
দাম আকাশছোঁয়া
খুলনার নিউ মার্কেট ও ময়লাপোতা কিচেন মার্কেটে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৭০০ টাকায়।
- ৭০০–৯০০ গ্রামের মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০০ টাকায়
- ৬০০–৭০০ গ্রামের মাছ ১৯০০ টাকায়
- ৪০০–৬০০ গ্রামের ছোট মাছ প্রায় ১২০০ টাকায়

মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে
গৃহিণী মাসুমা লিমা বলেন, “মৌসুমেও ইলিশ আমাদের নাগালের বাইরে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিনতে পারিনি। সংসারের খরচ মেটানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বছরে এক-দুবার নদীর ইলিশ খাওয়ার সুযোগ যদি না পাই, তবে আর কী-ই বা থাকে! এখন ফেসবুকে ছবিই শুধু দেখে মন ভরাই।”

ব্যবসায়ীরাও বিপাকে
নিউ মার্কেটের মাছ ব্যবসায়ী বাদশা মোরল বলেন, “এই দামে আমাদের জন্যও মাছ মজুত রাখা কঠিন হয়ে গেছে। ক্রেতা আসে না। সারাদিন বসে থেকেও হাতে গোনা কয়েকটা মাছ বিক্রি হয়। পরিবহন খরচ, দোকানভাড়া আর কর্মচারীর বেতন দেওয়ার পর হাতে কিছুই থাকে না। আগে এই ব্যবসা দিয়েই সংসার চলত, এখন মৌসুমেও লাভ নেই।”
অন্য ব্যবসায়ী প্রান্ত জানান, “দিনে পাঁচ-সাতজন ক্রেতা এলেও দাম শুনে অনেকেই চলে যান। চাহিদা কমে গেছে। অনেক সময় মাছ দুই-চার দিন অবিক্রীত থেকে যায়, শেষে খরচের দামে বা তারও কমে বিক্রি করতে হয়। এখন ইলিশ বিক্রি সত্যিই খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















