ঢাকার পুরনো অংশের ইতিহাস কেবল ইমারত, কবর, মসজিদ আর খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে লুকিয়ে আছে অগণিত পেশা, অভ্যাস আর সংস্কৃতি, যা আজও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেঁচে আছে। তারই একটি অংশ হলো কালো সাবান। আধুনিক ডিটারজেন্ট আর ব্র্যান্ডেড সাবানের দাপটের মাঝেও এখনও পুরনো ঢাকার কিছু পরিবার কালো সাবান ছাড়া কাপড় ধোয় না। আর সেই সাবান আজও মাথায় ঝাঁপি তুলে বিক্রি করে বেড়ান এক নারী— যেন অতীতের এক জীবন্ত সাক্ষ্য।
কালো সাবানের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে কালো সাবানের ইতিহাস কয়েকশো বছরের পুরনো। এটি মূলত তৈরি হয় তেল, সোডা ও প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে। রঙ কালচে বলে নাম হয়েছে কালো সাবান।
- টেকসই:অল্প পরিমাণেই দীর্ঘদিন চলে।
- দাগ তোলার ক্ষমতা:বিশেষ করে সাদা কাপড়ের জন্য অদ্বিতীয়।
- অর্থসাশ্রয়ী:কম দামে সহজলভ্য।
- গ্রামীণ ঐতিহ্য:গ্রামে মাটির হাঁড়ি-পাতিল পরিষ্কার করতে কালো সাবান এখনও ব্যবহার হয়।
আজকের দিনে নানা ধরনের ডিটারজেন্ট বাজারে এলেও কালো সাবানের স্থায়ী এক জায়গা রয়েছে, বিশেষত পুরনো ঢাকার গৃহস্থালির মধ্যে।
নারী বিক্রেতার সকাল
লালবাগ এলাকার একটি জরাজীর্ণ বাসায় ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙে রহিমা বেগমের (ছদ্মনাম)। স্বামী বহু বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সংসারের ভার কাঁধে তোলেন তিনি। মাথায় এক ঝাঁপি ভরে কালো সাবান সাজিয়ে নেন। প্রতিটি টুকরোর দাম ১০ থেকে ২০ টাকা।
কাঁধে নয়, বরং মাথায় তুলতে অভ্যস্ত রহিমা। বলেন—
“মাথায় নিলে ভারী বোঝাও হালকা লাগে। সারা দিন ঘুরতে হয়, তাই এভাবেই ভালো।”
তিনি সকাল আটটার মধ্যেই চকবাজারের গলি ধরে হাঁটা শুরু করেন। সরু রাস্তায় রিকশার ভিড়, পাশ দিয়ে ভেসে আসা বিরিয়ানির সুগন্ধ আর লাল চায়ের ধোঁয়া মিলেমিশে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করে। সেই ভিড়ের ভেতর দিয়ে তিনি ধীর পায়ে চলতে থাকেন।
অলিগলির গল্প
পুরনো ঢাকার অলিগলি যেন এক নিজস্ব পৃথিবী। দেয়ালে ঝুলে থাকা সাইনবোর্ড, ছাদের ওপরে শুকনো কাপড়, দোকানদারের হাঁক— সবকিছু মিলিয়ে এক জীবন্ত কোলাহল।
যখন রহিমা কোনো বাড়ির সামনে দাঁড়ান, ভেতর থেকে গৃহিণীরা ডেকে ওঠেন—
“আপা, কালো সাবান আছে?”
তিনি ঝাঁপি নামিয়ে গুনে গুনে টুকরো দেন। অনেকেই একসঙ্গে পাঁচ-ছয়টা কিনে রাখেন।

ক্রেতাদের অভ্যাস ও বিশ্বাস
পুরনো ঢাকার বয়স্ক মহিলাদের বিশ্বাস—
“ডিটারজেন্ট যত ভালোই হোক, কালো সাবান ছাড়া কাপড় ঝকঝকে হয় না।”
অনেকে আবার বলেন, ডিটারজেন্টে কাপড়ের রঙ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু কালো সাবান কাপড়ের আয়ু বাড়ায়। বিশেষ করে সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি কিংবা ওড়নার জন্য কালো সাবানই শ্রেষ্ঠ।
সংগ্রামের গল্প
রহিমার জীবন কেবল সাবান বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি তার বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্পও।
- পরিবার:তিন সন্তানের দায়িত্ব তার কাঁধে।
- আয়:দিনে ২০০–৩০০ টাকা রোজগার হয়, তাতে কোনোভাবে সংসার চলে।
- ক্লান্তি:গরমে ঘাম, শীতে ঠান্ডা, বর্ষায় কাদা— সব সহ্য করেই মাথায় ঝাঁপি নিয়ে ঘুরতে হয়।
তবুও তার মুখে হাসি রয়েছেই। বলেন—
“আমার সাবান কিনে কেউ খুশি হলে, মনে হয় জীবনে কিছু একটা করতে পারছি।”
কালো সাবানের বাজার সংকট
আজকের দিনে ডিটারজেন্ট ও ব্র্যান্ডেড সাবান বাজার দখল করলেও, কালো সাবানের টিকে থাকার কয়েকটি কারণ আছে—
সস্তা দাম – নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য উপযোগী।
বিশ্বাসের জায়গা – পুরনো ঢাকার পরিবারগুলো অভ্যাস ছাড়তে চান না।
গৃহস্থালি প্রয়োজন – বিশেষ কিছু কাপড় বা বাসন পরিষ্কারের জন্য একে অপরিহার্য মনে করা হয়।
তবে ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেন, বিক্রি আগের মতো নেই। নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে ডিটারজেন্টে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহ্যের রঙ
কালো সাবান যেন এক ঐতিহ্য। এর গন্ধ, টেক্সচার, এমনকি হাতে ফেনা ওঠার অনুভূতিও পুরনো প্রজন্মকে অতীতের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এক গৃহিণী বলেন—
“যখন মা বেঁচে ছিলেন, প্রতি শুক্রবার তিনি কালো সাবান দিয়ে কাপড় ধুতেন। আজও আমি তা করি।”
রহিমা বেগমের মতো এক নারীর মাথার ঝাঁপিতে ভরসা করে টিকে আছে এই ঐতিহ্য। কালো সাবান শুধু একটি সাবান নয়— এটি এক সময়ের জীবন্ত ইতিহাস, পুরনো ঢাকার গৃহস্থালির স্মৃতি, আর সংগ্রামী মানুষের জীবিকার অবলম্বন।
যতই আধুনিকতা আসুক, চকবাজারের অলিগলিতে সেই পরিচিত হাঁক শোনা যাবে—
“আপা, কালো সাবান লাগবে?”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















