ভাসানচর দ্বীপ নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণে, মেঘনা মোহনার পলিতে গত দুই দশকে গঠিত একটি নতুন চর। সরকারি আশ্রয়ণ–৩ প্রকল্পের আওতায় দ্বীপটিতে বাঁধ, আবাসন, সড়ক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভাসানচর দ্বীপ এখন শুধু মানবিক পুনর্বাসনের কেন্দ্র নয়; কৃষি, মৎস্য ও সামুদ্রিক নিরাপত্তায়ও এটি কৌশলগত গুরুত্ব পাচ্ছে।
দ্বীপ রক্ষায় নির্মিত মাটি–বাঁধটি প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও প্রায় ৯ ফুট উঁচু; ধাপে ধাপে উচ্চতা বাড়ানোর পরিকল্পনাও আছে। বাঁধ, গ্রিন–বেল্ট ও নালা–ড্রেনেজ মিলিয়ে জলোচ্ছ্বাস ও অতিবৃষ্টিজনিত পানি নামানোর জন্য বহুস্তর সুরক্ষা রাখা হয়েছে। আবাসনের ক্ষেত্রে প্রায় ১২০টি হাউজিং ক্লাস্টারে ব্যারাকঘর নির্মিত, যেখানে প্রতিটি ব্যারাকে ১৬টি পরিবার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কংক্রিট সড়ক, ঘাট, হেলিপ্যাড, সৌরবিদ্যুৎ ও গভীর নলকূপের পাশাপাশি কমিউনিটি ক্লিনিক ও হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বাজার ও উপাসনালয় চালু রয়েছে। দুর্যোগ–পরিস্থিতি মোকাবিলায় আশ্রয়কেন্দ্র ও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সরকার কক্সবাজার ক্যাম্পের চাপ কমাতে ভাসানচরে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে মোট ১ লক্ষ মানুষ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রায় ৩৫ হাজার শরণার্থী এখানে স্থানান্তরিত হয়েছেন। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার কর্মসূচি চলছে। জীবিকায়ন উদ্যোগ হিসেবে হাঁস–মুরগি পালন, পুকুরে মাছচাষ, সবজি বাগান ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে; এতে স্বনির্ভরতার প্রাথমিক সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত থাকায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় মানবিক সহায়তার ধারাবাহিকতা, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষতা–ভিত্তিক কর্মসূচি বিস্তৃত করা জরুরি।

অর্থনৈতিকভাবে দ্বীপটির মাটি ধান–সবজি উৎপাদনে উপযোগী হওয়ায় টেকসই কৃষি পরিকল্পনা সম্ভাবনা দেখায়। চারপাশের নদী ও মোহনায় ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের প্রাচুর্য থাকায় সুশাসিত আহরণ, হিমায়ন ও বাজার–সংযোগ নিশ্চিত হলে স্থানীয় অর্থচক্রে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি, বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক সীমানা, জেলে–নিরাপত্তা, মাদক ও মানবপাচার রোধে নৌবাহিনী–কোস্টগার্ডের উপস্থিতি কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে। নিরাপদ যোগাযোগ, পরিবেশ–বিধি ও কমিউনিটি অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে ভবিষ্যতে স্বল্প–মাত্রার ইকো–ট্যুরিজমও বিবেচনায় আসতে পারে।
তবে পরিবেশগত ঝুঁকি বাস্তব। লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়–ঝুঁকি কমাতে বাঁধ–উচ্চতা, ড্রেনেজ, সাইক্লোন–শেল্টার ও ম্যানগ্রোভ বনায়ন নিয়মিত হালনাগাদ রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্র–পৃষ্ঠ উঁচু হলে অভিযোজন–পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে তথ্য–স্বচ্ছতা, শরণার্থীদের মতামত ও সুরক্ষা–মানদণ্ড কঠোরভাবে মেনে চলা দরকার। সার্বিকভাবে, পরিকল্পিত বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে পারলে ভাসানচর দ্বীপ মানবিক সুরক্ষা ও আঞ্চলিক সম্ভাবনার একটি টেকসই মডেল হয়ে উঠতে পারে—এবং ভাসানচর দ্বীপ বিষয়ে নীতিনির্ধারণে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিই হবে নির্ণায়ক।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















