গেল ফেব্রুয়ারিতেও এক লাখ তিন হাজার টাকা বেতন পেতেন সাদিক গালিব। ভ্যাট, ট্যাক্স কেটে ৮৯ হাজার ছয়শো টাকা তার পকেটে থাকতো। সে সময় তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করতেন। কিন্তু বিয়ের দুই দিনের মাথায় চাকরি হারানোর খবর পান তিনি।
ওই সময় চাকরি হারানো ঠিক কতটা ভয়াবহ ছিল তা “কাউকে বলে বোঝানো যাবে না” বলে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. গালিব।
তিনি জানান, মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে চাকরি ছিল না তার। তবে মাস দু’য়েক আগে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থায়। এখন এই সেপ্টেম্বরে মি. গালিবের মাসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকা, অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে বেতন।
মি. গালিব বলেন, “বেতন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক আঘাত যেমন খুবই ম্যাসিভ, তেমনি সাইকোলোজিক্যাল যে আঘাত তাও খুবই ম্যাসিভ।”
প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে বলে গত জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো জানানো হয় তাদের। পরে সব প্রক্রিয়া শেষ করে তেসরা মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ওই প্রতিষ্ঠান।
“পরিবারে যেই প্রভাবটা পড়ে… ধরুন একজন মেয়ে দেখছে হাজবেন্ড এতো টাকা উপার্জন করে, মাস গেলে বেতন আসতেছে। তারপর হুট করে একদিন চাকরি নাই। দুই-তিন মাস বাড়িতে বসে থাকলো.. এটা তো মানসিকভাবে একটা বিরাট আঘাত” বলেন মি. গালিব।
বৈশ্বিক এ প্রেক্ষাপটে মি. গালিবের মতো চাকরি হারানোর উদাহরণ বাংলাদেশে হাজার হাজার।
এছাড়াও পাঁচই অগাস্টের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত হিসেবে পরিচিত গার্মেন্টস সেক্টরেও কারখানা বন্ধের ফলে শ্রমিকরা চাকরি হারিয়েছেন।
বকেয়া বেতন না দিয়েই কারখানা বন্ধের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে বড় ধরনের নতুন বিনিয়োগ না থাকায় কর্মসংস্থানের হার তেমন একটা বাড়েনি। কিন্তু জীবনযাপনের ব্যয় ঠিকই বাড়ছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে সঙ্গতি রেখে চলতে গিয়ে আরও বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষদের।

‘পরিবার ও ছেলের পড়ালেখার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে’
৪৯ বছর বয়সী হাবিবুর রহমান শেখ ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে চাকরি হারানোর পর এখন পিরোজপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকছেন। ভোলায় একটি এনজিওতে প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি
গত আট মাসে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোথাও তাকে আর নিয়োগের জন্য ডাকা হয়নি। ফলে এখন পর্যন্ত কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন তিনি।
গত ২০শে জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ইউএসএআইডির তহবিল এবং সংস্থাটির তহবিলভুক্ত কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দেন।
বাংলাদেশে এই তহবিলের প্রায় শ’খানেক প্রকল্পের বেশির ভাগই বাতিলের সিদ্ধান্তে বেকারত্বের মুখোমুখি হওয়া হাজার হাজার উন্নয়ন পেশাজীবীদের মধ্যে হাবিবুর রহমান শেখ একজন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই তহবিলের টাকায় কয়েকশ বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে এবং এসব প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক সহায়তা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতি বছর দেওয়া সহায়তার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।
এর আগের বছরগুলোতে আড়াইশো থেকে তিনশো মিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এই সংখ্যাটা প্রায় ৪৯০ মিলিয়ন ডলার ছিল।
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ইউএসএইড এর তথ্য বলছে, এই অর্থ যেসব খাতে ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা।
এছাড়া, রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তার জন্যও বরাদ্দ ছিল এতে।
অন্যান্য বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি কার্যক্রমের অর্থায়ন বজায় থাকবে ইউএসএইডের বরাতে জানুয়ারিতে এমনটি জানিয়েছিল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
২০০০ সাল থেকে প্রায় ২৪ বছর যাবৎ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার প্রজেক্টে কাজ করেছেন হাবিবুর রহমান শেখ। ঋণ নিয়ে কিছু টাকা পোস্ট অফিসে সঞ্চয় করেছিলেন, ওই টাকার সুদ দিয়েই সংসার খরচ চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

কীভাবে সংসার চলছে এমন প্রশ্নে ফোনের ওপারে থাকা মি. শেখ বেশ কিছু মুহূর্ত নীরব থাকেন।
একটু পর জানান, অনার্স পড়ুয়া ছেলের পড়ালেখা ও সংসার খরচ চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।
এক পর্যায়ে বিবিসি বাংলাকে মি. শেখ বলেন, “আগে ছেলের পড়ার খরচ ছাড়াই ১২ হাজার টাকায় সংসার চালাইতাম। এখন তিন হাজার টাকা সংসার খরচ।”
“এখন মাসিক নয় হাজার টাকার মধ্যে ছেলের পড়ার খরচ দিতে হয় ছয় হাজার টাকা। পড়ালেখার ব্যয় বহন করাই এখন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। বাকি টাকায় না হয় চিকিৎসার খরচ, না চলে ঠিকমতো সংসারের ব্যয়,” বলেন তিনি।
শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ নানা রকম নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ধরেন যে জিনিসের দাম বছরখানেক আগেও একশ’ টাকা ছিলো তা বেড়ে দুইশ’ টাকা হইছে।”
এই বাড়তি খরচ বহন করা ‘দুঃসাধ্য’ কাজ বলে মনে করেন তিনি।
মি. শেখ বলছিলেন, এনজিও সেক্টরে চাকরির সার্কুলার নেই বললেই চলে। অল্প কিছু চাকরি থাকলেও ফান্ড বন্ধ হওয়ার কারণে চাকরির বাজারে হাজার হাজার মানুষের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। আর বেশিরভাগ এনজিওতেই অভ্যন্তরীণভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এখন চাকরির বাজারে তুলনামূলক কম বয়সীদেরই প্রাধান্য বেশি বলে জানান তিনি। অভিজ্ঞতার কোনো গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করেন মি. শেখ।

‘টেনশন ভিতরে যে এই ঋণটা দেবো কীভাবে?’
বাংলাদেশে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের কর্মসংস্থানের একটি অন্যতম খাত গার্মেন্টস সেক্টর।
পাঁচই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে গেছে শত শত শিল্প – কারখানা।
শিল্পাঞ্চল পুলিশের আটটি অঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে গার্মেন্টস বন্ধ হয়েছে দুই শ’য়ের বেশি। তবে কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে এই সংখ্যা তিন শতাধিক বলে দাবি করা হয়েছে।
কারখানা বন্ধের ফলে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
গার্মেন্টস থেকে কাজ হারানো নাসিমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এর আগে স্বামী, স্ত্রী ও মেয়েসহ তিন জন রোজগার করতেন। কিন্তু এখন সংসার চলে এক জনের আয়ে।
৩৫ বা ৩৬ হাজার টাকার পরিবর্তে মিজ নাসিমার সংসারের আয় কমে এখন দাঁড়িয়েছে ১০ বা ১২ হাজার টাকায়।
মিজ নাসিমা বলেন, “এখন মেয়েরও চাকরি নাই, আমারও চাকরি নাই। কালকে অটোর ব্যাটারি পুইড়ে গেছে এখন জামাইটাও বাসায় বসা। মানে আমার ফ্যামিলির এখন সবাই বাসায় বসা।”
তিনি জানান এখন পোশাককর্মীরাও টাকা বাঁচাতে গার্মেন্টস পাঁচটায় ছুটির পর দশ টাকা অটো ভাড়া খরচ করেন না। বরং তা বাঁচিয়ে হেঁটে যান। তাই অটোরিক্সার ভাড়াও নেই।
“দিন গেলে চারশো-পাঁচশো টাকা কোনো রকমে যাই নিয়ে আসে তাই দিয়ে দিন যাচ্ছে,” বলেন মিজ নাসিমা।
সঞ্চয় ভেঙে বেশি দিন চলা যাবে না, ফলে ভবিষ্যতের চিন্তায় আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন জানিয়ে নাসিমা বলেন, “কোনে (কোথায়) ৩৫ – ৩৬ হাজার, আর কোনে ১৫ হাজার? ১০- ১২ হাজার টাকায় আমাক মেকাপ করতে হচ্ছে। তাইলে আমি ঋণী হয়ে যাচ্ছি না? টেনশন ভিতরে যে এই ঋণটা দেবো কীভাবে,” বলেন মিজ নাসিমা।
কারখানা বন্ধের পরে যারা কাজ হারিয়েছেন এমন কয়েকজন নারী পোশাককর্মী জানিয়েছেন, এখন চাকরি পেতে বয়সও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কম বয়সী কর্মীদেরই কাজে নেওয়া হচ্ছে বেশি।

বেকারত্ব বেড়েছে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ২৪ লাখ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশ জুড়ে প্রায় ২১ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চাকরি হারানো ২১ লাখের মধ্যে প্রায় ১৮ লাখই নারী।
এ বিপুল সংখ্যক নারী চাকরি হারানোর ঘটনা মোট চাকরি হারানোর প্রায় ৮৫ শতাংশ।
তবে সরকারি এই হিসাব নিয়ে গবেষকদের প্রশ্ন রয়েছে। তারা মনে করেন, সরকার যে হিসাব দেয় প্রকৃত সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২২ সাল থেকে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকগুলো ব্যাংক খাত থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি খুবই দুর্বল অবস্থানে ছিল।
ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রায় স্থবিরতার দিকে চলে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিশীলতা হারিয়েছে।
সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “২০২৪ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে সেটার প্রভাবও কর্মসংস্থানের ওপরে পড়েছে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালে বেকারত্বের হারে বড় ধরনের অবনমন দেখেছি। নতুন কর্মসংস্থান তো সৃষ্টি হয়ইনি, বরং আমার যে মোট কর্মসংস্থান ছিলো এটা কমে গেছে।”
তবে, এই কর্মসংস্থান এখন পর্যন্ত কোন খাতে কত কমলো সে বিষয়ে আট মাস পার হলেও বিবিএস এখনো পুরো পরিসংখ্যান দেয়নি বলে উল্লেখ করেন মি. খান।
ফলে বিবিএসের কাছ থেকে গুণগত তথ্য না পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে নীতি তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়েছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, গত এক বছরে চাকরির সার্কুলার খুবই কম। ফলে একবছর পার হলেই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্ত হয়।
অ্যাসোসিয়েশন অব আনএমপ্লয়েড ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনালস (অডিপ) এর আহ্বায়ক জিনাত আরা আফরোজ বিবিসি বাংলাকে জানান, কেবলমাত্র ইউএসএইডের ফান্ড স্থগিত হওয়ার কারণেই ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
“তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো কর্মহীন। তারা কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেছেন, কেউ কেউ খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















