ভূমিকা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রকৃতির এক অনন্য রূপে সাজানো। নদী, খাল, জঙ্গল আর জনপদ মিলিয়ে এই ভূখণ্ড এক বিস্ময়কর জীবনচক্র তৈরি করেছে। বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার কাছে অবস্থিত ঢাংমারি নদী (স্থানীয়ভাবে ঢাংমারি খাল নামেও পরিচিত) সেই জীবনচক্রের একটি অপরিহার্য অংশ।
একদিকে সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল, অন্যদিকে নদীভিত্তিক জীবনযাত্রা—ঢাংমারি নদী যেন প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের এক প্রতীক। এখানে নদীর স্রোত, জোয়ার-ভাটা, বনের পশুপাখি, মানুষের কৃষিজীবন, জেলেদের জাল টানা, ঝড়-বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রাম—সবকিছু মিলে এক বহমান কাব্যের জন্ম দিয়েছে।
ঢাংমারি নদী কেবল একটি জলধারা নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, একটি সংস্কৃতির উৎস এবং মানুষের টিকে থাকার কাহিনি। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি বাতাস, প্রতিটি সন্ধ্যা মনে করিয়ে দেয়—সংগ্রামই জীবন, আর নদীই সেই সংগ্রামের পথপ্রদর্শক।
ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট
ঢাংমারি নদী পশুর নদীর শাখা। পশুর নদী মোংলা বন্দরের প্রাণ, আর ঢাংমারি তারই শান্ত অথচ জীবন্ত ধারা। নদীর দুই পাশে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন, যা সুন্দরবনের সম্প্রসারিত অংশ।
বর্ষায় নদীর জলধারা ভরে ওঠে। খাল-বিল, মাঠ সব মিলেমিশে যায় নদীর সাথে। শীতে নদী শান্ত হয়ে যায়, জলস্বল্পতায় নীলাভ রূপ নেয়। গ্রীষ্মে নদীর কাদামাটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। এভাবে ঋতুচক্র নদী ও মানুষকে একসাথে গেঁথে রাখে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
পঞ্চদশ শতকে খান জাহান আলী খলিফাতাবাদ নগরী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনার মূল ভিত্তি ছিল নদীপথ। ঢাংমারি নদী সরাসরি বাণিজ্যকেন্দ্র না হলেও স্থানীয় জনগণের জীবনধারায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখান থেকেই কৃষিজাত দ্রব্য, মাছ ও খেজুরের গুড় নৌকায় করে বাজারে যেত।
নদী শুধু খাদ্য বা পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং বসতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই নদী মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
জঙ্গল ও জীববৈচিত্র্য
ঢাংমারি নদীর দুই পাড় জুড়ে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এখানে সুন্দরী, গরান, গোলপাতা, কেওড়া, হেঁতাল গাছের সমারোহ। জোয়ারে ভেসে আসে লোনা পানি, ভাটায় গাছের শেকড় উঁকি দেয়।
এখানে দেখা যায় চিত্রা হরিণ, বানর, বুনো শূকর, শকুন, ঈগল এবং অসংখ্য পাখি। নদীর বুকে ডলফিন খেলতে দেখা যায়। অরণ্যের গহীনে লুকিয়ে থাকে সাপ, কুমির ও অজগর। প্রকৃতি যেন এখানে নিজের রাজ্য গড়ে তুলেছে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি
ঢাংমারি অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতি অস্বীকার করার উপায় নেই। মাঝে মাঝে শিকার বা খাদ্যের খোঁজে তারা নদীর পাড় পর্যন্ত চলে আসে। স্থানীয়রা এখনো বাঘের গর্জন শোনার গল্প বলেন। অনেক জেলে ও মধু সংগ্রহকারী বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এই ভয় নদীপাড়ের জীবনে এক ধরনের স্থায়ী ছায়া ফেলেছে। তবে ভয়ের পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধও তৈরি করেছে।

মাছ ও জলজ সম্পদ
ঢাংমারি নদী মাছের ভাণ্ডার। ভেটকি, পারশে, রূপচাঁদা, , ট্যাংরা, বাগদা, ছোট চিংড়ি ও গলদা চিংড়ি ও কাঁকড়া এখানকার প্রধান সম্পদ। নদীর সাথে যুক্ত খালগুলো বর্ষায় মাছের প্রধান আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
শীতকালে নদীর স্বচ্ছ জলে ডলফিনের লাফিয়ে খেলা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। মাছ ও জলজ সম্পদ স্থানীয় অর্থনীতি ও খাদ্যাভ্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কৃষিজীবন
নদীপাড়ের জমি বর্ষার পর উর্বর হয়ে ওঠে। আমন ধান এখানে প্রধান ফসল। রবি মৌসুমে মুগ, খেসারি, তিল, পাট, শাকসবজি ও তরমুজ চাষ হয়। খেজুরের গাছ এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। শীতে খেজুর থেকে গুড় তৈরি হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
ধান কাটার সময় নারী-পুরুষ মিলেমিশে কাজ করে। তারা মাঠে গান গায়—যেখানে নদী, ঝড়, বাঘের ভয়, জীবনের আনন্দ সব একসাথে ফুটে ওঠে।
স্থানীয় উৎসব ও সংস্কৃতি
ঢাংমারি নদীপাড়ের মানুষ উৎসবে প্রাণবন্ত।
- পহেলা বৈশাখ:নদীর তীরে মেলা বসে, থাকে লোকসংগীত, হস্তশিল্প ও খেলনা।
- নৌকাবাইচ:বর্ষার শেষে সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব। শত শত বৈঠার শব্দে নদী গর্জে ওঠে, গ্রামজুড়ে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে।
- ধর্মীয় উৎসব:ঈদ, দুর্গাপূজা, নববর্ষ—সব একসাথে পালন হয়।
- লোকসংগীত:বাউল গান, কীর্তন, শ্রমজীবী গান—সবই নদী ও প্রকৃতিকে ঘিরে রচিত।
এই উৎসবগুলো নদীপাড়ের মানুষের বন্ধনকে শক্ত করে, তাদের জীবনের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়।

জেলে সম্প্রদায়ের জীবনসংগ্রাম
ভোরের আলো ফোটার আগে জেলেরা নৌকা নিয়ে নদীতে নামে। সারাদিন জাল ফেলে মাছ ধরে। কখনো প্রচুর মাছ মেলে, আবার কখনো খালি হাতে ফিরতে হয়। ঝড়, সাইক্লোন, এমনকি বাঘের ভয়—সবকিছুর সাথে তাদের প্রতিদিন লড়তে হয়।
তবুও নদীর সাথে তাদের টান অটুট। নদী তাদের মা, আবার কখনো মৃত্যুর ফাঁদ। তাদের গান, গল্প, হাসি-কান্না সব নদীর বুকে প্রতিধ্বনিত হয়।
সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা
ঢাংমারি নদীর সন্ধ্যা অনন্য। সূর্যাস্তের সময় নদীর পানিতে সোনালি রঙ খেলে যায়। শিশুরা নদীর ধারে খেলে, নারীরা হাঁস-মুরগি গোসল করায়। দূরে শোনা যায় বৈঠার ছপছপ শব্দ, আর বাতাসে ভেসে আসে লোকগান।
সন্ধ্যার এই নিস্তব্ধতা যেন গ্রামীণ জীবনের শান্তির প্রতিচ্ছবি।
ঝড়-বিপর্যয়ের গল্প
ঢাংমারি নদীপাড়ের মানুষ বারবার ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করেছে। সিডর, আইলা, আম্পান—প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় ধ্বংস নামিয়েছে। ঘরবাড়ি ভেসে গেছে, ফসল নষ্ট হয়েছে, মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
কিন্তু মানুষ হাল ছাড়ে না। তারা আবার ঘর তোলে, আবার জমি চাষ করে। এটাই তাদের জীবনের মন্ত্র—প্রকৃতির সাথে লড়ে টিকে থাকা।

পুনর্গঠন ও মানবিক গল্প
ঝড়ের পর গ্রামে দেখা যায় অসাধারণ মানবিকতা। প্রতিবেশী প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ায়। নারীরা একসাথে খিচুড়ি রান্না করে সবার মধ্যে ভাগ করে। শিশুরা আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদ থাকে। সাহায্য আসে, কিন্তু স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ওঠে।
পর্যটন ও সম্ভাবনা
ঢাংমারি নদী এখন পর্যটনের সম্ভাবনাময় স্থান। ডলফিন দেখা, নৌকাভ্রমণ, ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর হাঁটা—এসব অভিজ্ঞতা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। স্থানীয় ইকো-রিসোর্ট এবং বন বিভাগের উদ্যোগে টেকসই পর্যটন এগিয়ে চলেছে।
তবে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে এই পর্যটনকে এগিয়ে নিতে হবে।
ঢাংমারি নদী কেবল একটি নদী নয়; এটি এক বহমান কাব্য। জঙ্গল, বাঘ, মাছ, কৃষি, উৎসব, ঝড়-বিপর্যয়, পুনর্গঠন—সব মিলিয়ে এটি জীবনের এক মহাকাব্য।
এই নদী শেখায় মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পরের পরিপূরক। প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করেই টিকে থাকা সম্ভব। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি সন্ধ্যা বলে—সংগ্রামই জীবন, আর নদী সেই সংগ্রামের পথপ্রদর্শক।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















