রাজসাহী জেলা প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতির বাস। হিন্দু জাতিকে নিম্নের আট শ্রেণিতে বিভাগ করা যাইতে পারে।
পুরাকালে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণ ব্যতীত পঞ্চম বর্ণ ছিল না। প্রথম তিন বর্ণের মাতৃগর্ভে প্রবেশ হেতু এক জন্ম এবং সংস্কার হইয়া যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন বলিয়া আর এক জন্ম হয়। এই হেতু ঐ প্রথম ত্রৈবর্ণ দ্বিজ বলিয়া পরিচিত। শূদ্রের কেবল মাতৃগর্ভে প্রবেশকে এক জন্ম বলিয়া “একজ” নামে খ্যাত। শূদ্রেরা যজ্ঞোপবীত ধারণ করে না। এই চারি জাতি ব্যতীত বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাক প্রভৃতি যে জাতিগুলি দেখা যায়, ইহারা শূদ্রজাতির অন্তর্ভূত কি প্রথম তিন বর্ণের অন্তর্গত ইহা তর্ক বিতর্কের কথা। যদি বৈদ্য ও কায়স্থ শূদ্রজাতির মধ্যে পরিগণিত না হয়, তবে তাহারা কি প্রথম তিন বর্ণের কোন একটি বর্ণ হইতে উৎপন্ন? তবে কি তাহারা বর্ণসঙ্কর? এ প্রশ্নগুলির ঠিক মীমাংসা করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। অতি প্রাচীনকালে আর্যজাতিদের মধ্যে প্রথমে জাতিভেদ ছিল না বলিয়া সাধারণের প্রতীতি হয়। প্রথমে সকল জাতির মধ্যে পরস্পর আহার, বিহার, উপবেশন প্রচলিত ছিল। সমাজের কাজকর্ম সুবিধামত চালাইবার জন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি শ্রেণিতে আর্যজাতি বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মণেরা বেদজ্ঞ হইয়া জ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষার ভার গ্রহণ করিলেন। এইরূপে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ এবং পরে পরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র জাতির সৃষ্টি হইয়া জাতিভেদ হইল। জাতিভেদ হওয়ার পরেও উচ্চ জাতিয়েরা নীচ জাতির কন্যার পানিগ্রহণ করিতে পারিতেন। ইহাও নিয়ম ছিল যে নীচ জাতিয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি বুদ্ধিমান হইলে তাহাকে সংস্কার করিয়া যজ্ঞোপবীত ধারণ করান হইত এবং ঋষিরা তাহাকে বেদ অধ্যয়ন করাইয়া ব্রাহ্মণ করিতেন। ইহাতে এই বলা যাইতে পারে যে, শূদ্র যদিও ব্রাহ্মণের ন্যায় জ্ঞানী ও ধার্মিক হইত, তবে সে শূদ্রও ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মানিত হইত। “যাহারা বেদহীন ও আচার ভ্রষ্ট হইয়া সমস্ত কার্যের অনুষ্ঠান ও সকল দ্রব্য ভক্ষণ করে তাহারাই শূদ্র বলিয়া পরিগণিত হয়।” এই মহাভারতীয় বাক্যের উপর নির্ভর করিলে, ইহা বলা যাইতে পারে যে পুরাকালে আর্যসন্তান বেদহীন আচার ভ্রষ্ট হইলেই শূদ্র এবং সদ্গুণানুসারে ও ব্যবসানুসারে ব্রাহ্মাণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বলিয়া পরিগণিত হইত। অধুনা আর্যজাতি পূর্বের ন্যায় বেদজ্ঞ না হওয়ায় এবং কালক্রমে জাতিভেদ দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্বের ন্যায় জ্ঞান চর্চা বিহীনে, সকল জাতিরই হীন অবস্থা এবং জাতিভেদেরও বেশি বাড়াবাড়ি হইয়াছে। অতএব নানা জাতির ও বর্ণের সৃষ্টি এবং নানা পরিবর্তন জন্য কোন বিষয়ে ঠিক মীমাংসায় উপনীত হওয়া কঠিন।
এই রাজসাহী জেলায় ১৫০০ বা ১৬০০ ব্রাহ্মণের বাস। সাধারণত রাজসাহীর ব্রাহ্মণদিগকে পাঁচশ্রেণিতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। যথা- (ক) বারেন্দ্র, (খ) রাঢ়ী, (গ)বৈদিক, (ঘ) বর্ণ, (ঙ) কনৌজ। রাজা আদিশূরের পুত্রেষ্টি, যাগ সম্পন্ন জন্য কান্যকুব্জ হইতে দক্ষ, ভট্টনারায়ণ, শ্রীহর্ষ, বেদগর্ভ ও ছান্দড় নামে সাগ্নিক, বেদজ্ঞ ও সৎক্রিয়াশালী পঞ্চ ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসিয়া রাজপ্রদত্ত পঞ্চগ্রামে বাস করেন। ইহাদের বংশধরেরা কতকগুলি রাঢ়দেশে, ও কতকগুলি বরেন্দ্রভূমে বাস করেন। যাহারা বরেন্দ্রভূমে বাস করিতে লাগিলেন, তাহারা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ হইলেন।