০৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
স্যাম্পলের সিম্ফনি: ড্যানিয়েল লোপাটিনের পরীক্ষামূলক সাউন্ডস্কেপের নতুন বিস্তার এআই ভিডিও কমাতে ‘টোন ডাউন’ অপশন আনছে টিকটক রেকর্ড-নতুন ফল: চীনের জুনো ‘ঘোস্ট পার্টিকল’ ডিটেক্টরের অভাবনীয় সাফল্য ডেভনে আবার ফিরতে পারে বন্য বিড়াল: দুই বছরের গবেষণায় নতুন সম্ভাবনা প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২৭) নন-প্রফিট কাঠামোতে যাচ্ছে মাষ্টডন, সিইও পদ ছাড়ছেন প্রতিষ্ঠাতা ইউজেন রখকো” ইউটিউবে রেকর্ড ভিউ, তবু ‘বেবি শার্ক’ নির্মাতার আয় সীমিত কেন” চীনের এআই দৌড়ে তীব্র প্রতিযোগিতা, লোকসানে কেঁপে উঠল বাইদু গোপন সসের নিরাপত্তায় নতুন জোর দিচ্ছে রেইজিং কেইন’স  সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের নারীরা কীভাবে সংকটে পড়ছে

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাতিসংঘের Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও নদী বিধৌত এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, খরা এবং লবণাক্ততার বিস্তার মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় তৈরি করছে। এই পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারীরা। দারিদ্র্য, কর্মহীনতা ও সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে আটকে পড়ে তারা প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য যুদ্ধে লড়ছেন।

কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার সংকট

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবিকা কৃষিনির্ভর। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষি খাত থেকে আসে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কৃষিকে গভীর সংকটে ফেলেছে।

  • অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা:বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অতিবৃষ্টির কারণে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীরা মৌসুমি কৃষিশ্রমিক হিসেবে যেসব কাজে যুক্ত ছিলেন, সেসবের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়।
  • খরা ও পানির সংকট:উত্তরাঞ্চলে (রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর) খরার কারণে সেচনির্ভর কৃষি কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (BARC) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, খরার কারণে ২০-২৫ শতাংশ নারী কৃষিশ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
  • লবণাক্ততার বিস্তার:উপকূলীয় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় লবণাক্ততার কারণে প্রায় ১.২ মিলিয়ন হেক্টর জমি ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর ফলে কৃষিশ্রমিক নারীদের আয়ের সুযোগ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

ফলে কৃষি খাতের ভাঙন শুধু খাদ্য নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, নারীর কর্মসংস্থানকেও সংকুচিত করছে।

দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতি ও নারীর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা

প্রতি বছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন—বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (BIDS)-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

  • ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭),আইলা (২০০৯) ও আম্পান (২০২০) উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী তাদের কাজ ও জীবিকা হারিয়েছেন।
  • ঢাকা,খুলনা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে গিয়ে বাস্তুচ্যুত নারীরা অস্থায়ী কাজ পান। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শহরে আসা নারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেন। কিন্তু তাদের আয় গড়ে মাসে মাত্র ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা।
  • বাস্তুচ্যুত নারী ও শিশুরা প্রায়ই মানবপাচার ও যৌন শোষণের ঝুঁকিতে পড়েন।BRAC-এর ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, জলবায়ু অভিবাসী নারীদের ১৮ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে হয়রানি বা শোষণের শিকার হন।

নারীপ্রধান পরিবারের সংকট

বাংলাদেশে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী১২ শতাংশ পরিবার নারীপ্রধান। স্বামী মারা যাওয়া, বিদেশে প্রবাসে থাকা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব নারীর ওপর বর্তায়।

  • উপকূলীয় ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকায় নারীপ্রধান পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জমি হারিয়ে তারা ঋণের ফাঁদে পড়ছেন।
  • CARE Bangladesh-এর একটি জরিপে দেখা গেছে,জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নারীপ্রধান পরিবারের ৭০ শতাংশকে ঋণ নিয়ে চলতে হয়।
  • এই পরিবারগুলোর শিশুদের মধ্যে স্কুলছুটের হার বেশি,যার ফলে দারিদ্র্যের প্রজন্মান্তরিত চক্র আরও গভীর হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও সামাজিক বৈষম্য

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য নারীর স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

  • পুষ্টিহীনতা: UNICEF-এর তথ্য অনুযায়ী,উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। আয়ের ঘাটতির কারণে তারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না।
  • মানসিক চাপ: ActionAid-এর গবেষণায় দেখা গেছে,বাস্তুচ্যুত নারীদের ৬৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি তীব্র মানসিক চাপ ও উদ্বেগে ভুগছেন।
  • শিশুবিবাহ:দারিদ্র্যের কারণে পরিবারগুলো কন্যাশিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছে। Bangladesh National Women Lawyers Association (BNWLA)-এর তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শিশুবিবাহের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় দ্বিগুণ।

শ্রমবাজারে নারীর প্রান্তিকতা

বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার বর্তমানে প্রায় ৩৭ শতাংশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই হার স্থবির হয়ে আছে।

  • কৃষিশ্রমিক নারীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাচ্ছেন।
  • শহরে এসে যারা তৈরি পোশাক শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন,তারা নানা সংকটে পড়ছেন। Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association (BGMEA)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের মহামারির সময় প্রায় ২.৫ লাখ নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই জলবায়ু অভিবাসী।
  • International Labour Organization (ILO)-এর তথ্য অনুযায়ী,শহরমুখী নারীদের ৬৫ শতাংশ অস্থায়ী কাজে নিয়োজিত, যা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে না।

শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত শুধু অর্থনৈতিক নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে।

  • UNICEF-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী,উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু দুর্যোগের কারণে প্রাথমিক স্তরের ২০ শতাংশ মেয়ে স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে।
  • শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েরা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারায়,ফলে তারা অল্প মজুরির কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হয়।

রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নীতি

বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (BCCSAP) এবং বিভিন্ন অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে নারীর বিশেষ সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ এখনো পর্যাপ্ত নয়।

  • আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশ যে অর্থ পাচ্ছে,তার একটি বড় অংশ, নারী ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্পে ব্যয় করতে হবে।
  • নারীর জন্য টেকসই জীবিকার বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা জরুরি।

দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সমাধান হতে হবে বহুমাত্রিক।

নারীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান: কৃষির বাইরে হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা খাতে নারীর সুযোগ তৈরি করতে হবে।

শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি: জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মেয়েদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: নারীপ্রধান পরিবারের জন্য ভাতা, খাদ্য সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: বাস্তুচ্যুত ও কর্মহীন নারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করা: জলবায়ু অভিযোজন নীতিতে নারীর কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে।

 

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে তীব্রভাবে আঘাত করছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। এর মধ্যে নারীরা দারিদ্র্য ও কর্মহীনতার সবচেয়ে বড় শিকার। কৃষি ও জীবিকার ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিক্ষাবঞ্চনা এবং সামাজিক বৈষম্য তাদের জীবনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্যাম্পলের সিম্ফনি: ড্যানিয়েল লোপাটিনের পরীক্ষামূলক সাউন্ডস্কেপের নতুন বিস্তার

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের নারীরা কীভাবে সংকটে পড়ছে

০৩:০১:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জাতিসংঘের Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও নদী বিধৌত এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, খরা এবং লবণাক্ততার বিস্তার মানুষের জীবিকা ও অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় তৈরি করছে। এই পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারীরা। দারিদ্র্য, কর্মহীনতা ও সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে আটকে পড়ে তারা প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য যুদ্ধে লড়ছেন।

কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার সংকট

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবিকা কৃষিনির্ভর। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষি খাত থেকে আসে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কৃষিকে গভীর সংকটে ফেলেছে।

  • অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যা:বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অতিবৃষ্টির কারণে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীরা মৌসুমি কৃষিশ্রমিক হিসেবে যেসব কাজে যুক্ত ছিলেন, সেসবের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়।
  • খরা ও পানির সংকট:উত্তরাঞ্চলে (রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর) খরার কারণে সেচনির্ভর কৃষি কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (BARC) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, খরার কারণে ২০-২৫ শতাংশ নারী কৃষিশ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
  • লবণাক্ততার বিস্তার:উপকূলীয় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় লবণাক্ততার কারণে প্রায় ১.২ মিলিয়ন হেক্টর জমি ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর ফলে কৃষিশ্রমিক নারীদের আয়ের সুযোগ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।

ফলে কৃষি খাতের ভাঙন শুধু খাদ্য নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, নারীর কর্মসংস্থানকেও সংকুচিত করছে।

দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতি ও নারীর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা

প্রতি বছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন—বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (BIDS)-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

  • ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭),আইলা (২০০৯) ও আম্পান (২০২০) উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী তাদের কাজ ও জীবিকা হারিয়েছেন।
  • ঢাকা,খুলনা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে গিয়ে বাস্তুচ্যুত নারীরা অস্থায়ী কাজ পান। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শহরে আসা নারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেন। কিন্তু তাদের আয় গড়ে মাসে মাত্র ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা।
  • বাস্তুচ্যুত নারী ও শিশুরা প্রায়ই মানবপাচার ও যৌন শোষণের ঝুঁকিতে পড়েন।BRAC-এর ২০২২ সালের জরিপে দেখা গেছে, জলবায়ু অভিবাসী নারীদের ১৮ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে হয়রানি বা শোষণের শিকার হন।

নারীপ্রধান পরিবারের সংকট

বাংলাদেশে নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী১২ শতাংশ পরিবার নারীপ্রধান। স্বামী মারা যাওয়া, বিদেশে প্রবাসে থাকা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই পরিবারগুলোর দায়িত্ব নারীর ওপর বর্তায়।

  • উপকূলীয় ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকায় নারীপ্রধান পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জমি হারিয়ে তারা ঋণের ফাঁদে পড়ছেন।
  • CARE Bangladesh-এর একটি জরিপে দেখা গেছে,জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নারীপ্রধান পরিবারের ৭০ শতাংশকে ঋণ নিয়ে চলতে হয়।
  • এই পরিবারগুলোর শিশুদের মধ্যে স্কুলছুটের হার বেশি,যার ফলে দারিদ্র্যের প্রজন্মান্তরিত চক্র আরও গভীর হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও সামাজিক বৈষম্য

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য নারীর স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

  • পুষ্টিহীনতা: UNICEF-এর তথ্য অনুযায়ী,উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। আয়ের ঘাটতির কারণে তারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না।
  • মানসিক চাপ: ActionAid-এর গবেষণায় দেখা গেছে,বাস্তুচ্যুত নারীদের ৬৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি তীব্র মানসিক চাপ ও উদ্বেগে ভুগছেন।
  • শিশুবিবাহ:দারিদ্র্যের কারণে পরিবারগুলো কন্যাশিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছে। Bangladesh National Women Lawyers Association (BNWLA)-এর তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শিশুবিবাহের হার জাতীয় গড়ের তুলনায় দ্বিগুণ।

শ্রমবাজারে নারীর প্রান্তিকতা

বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার বর্তমানে প্রায় ৩৭ শতাংশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই হার স্থবির হয়ে আছে।

  • কৃষিশ্রমিক নারীরা কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাচ্ছেন।
  • শহরে এসে যারা তৈরি পোশাক শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন,তারা নানা সংকটে পড়ছেন। Bangladesh Garment Manufacturers and Exporters Association (BGMEA)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের মহামারির সময় প্রায় ২.৫ লাখ নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই জলবায়ু অভিবাসী।
  • International Labour Organization (ILO)-এর তথ্য অনুযায়ী,শহরমুখী নারীদের ৬৫ শতাংশ অস্থায়ী কাজে নিয়োজিত, যা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে না।

শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত শুধু অর্থনৈতিক নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে।

  • UNICEF-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী,উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু দুর্যোগের কারণে প্রাথমিক স্তরের ২০ শতাংশ মেয়ে স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে।
  • শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েরা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হারায়,ফলে তারা অল্প মজুরির কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হয়।

রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নীতি

বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (BCCSAP) এবং বিভিন্ন অভিযোজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে নারীর বিশেষ সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ এখনো পর্যাপ্ত নয়।

  • আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশ যে অর্থ পাচ্ছে,তার একটি বড় অংশ, নারী ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান প্রকল্পে ব্যয় করতে হবে।
  • নারীর জন্য টেকসই জীবিকার বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা জরুরি।

দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সমাধান হতে হবে বহুমাত্রিক।

নারীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান: কৃষির বাইরে হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা খাতে নারীর সুযোগ তৈরি করতে হবে।

শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি: জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মেয়েদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: নারীপ্রধান পরিবারের জন্য ভাতা, খাদ্য সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: বাস্তুচ্যুত ও কর্মহীন নারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করা: জলবায়ু অভিযোজন নীতিতে নারীর কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে।

 

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে তীব্রভাবে আঘাত করছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে। এর মধ্যে নারীরা দারিদ্র্য ও কর্মহীনতার সবচেয়ে বড় শিকার। কৃষি ও জীবিকার ক্ষতি, বাস্তুচ্যুতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, শিক্ষাবঞ্চনা এবং সামাজিক বৈষম্য তাদের জীবনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।