গত ছয় মাসে বাংলাদেশে মানসিক চাপ (স্ট্রেস) সম্পর্কিত রোগ যেমন উদ্বেগ, হতাশা, অনিদ্রা, এমনকি প্যানিক অ্যাটাকের মতো সমস্যার সংখ্যা দৃশ্যত বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি গবেষণা, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং সামাজিক পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই বৃদ্ধি হঠাৎ নয়, বরং দীর্ঘদিনের জমে থাকা সামাজিক-অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত চাপে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির যোগ হয়েছে।
অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও জীবিকা সংকট
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গত কয়েক মাসে সাধারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ পরিবারের বাজেট ভেঙে পড়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি, আয়-ব্যয়ের অমিল, এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করছে। এসব আর্থিক চাপ মানসিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা
রাজনৈতিক কর্মসূচি, আন্দোলন-সংঘর্ষ এবং আইনশৃঙ্খলার অনিশ্চয়তা সাধারণ মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। রাস্তায় বের হওয়া বা কর্মস্থলে যাওয়া নিয়ে ভয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা মানসিক রোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ
শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে মানসিক চাপে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট, ভর্তি ও চাকরির অনিশ্চয়তা, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার চাপ—এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন। অনেক তরুণ অনিদ্রা, উদ্বেগ ও হতাশায় ভুগছে, যা সরাসরি মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ডিজিটাল প্রভাব ও তথ্যের চাপ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয়, নেতিবাচক সংবাদ ও গুজবের প্রভাবও মানুষের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতিদিনের অস্থির পরিস্থিতির খণ্ডচিত্র ফেসবুক বা ইউটিউবের মাধ্যমে দেখার ফলে মানুষের ভয়ের মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল তথ্যের অতিরিক্ত এক্সপোজার উদ্বেগকে তীব্রতর করছে।

স্বাস্থ্যসেবায় সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো খুব সীমিত। রাজধানী ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই কম। ফলে মানুষ সমস্যা বুঝলেও পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পায় না। চিকিৎসা সেবার অভাব অনেককে অচিকিৎসিত অবস্থায় আরও জটিল মানসিক রোগে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিবার ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন
যৌথ পরিবারের ভাঙন, নগর জীবনের ব্যস্ততা, এবং প্রতিবেশী সম্পর্কের দুর্বলতা মানুষকে একাকী করে তুলছে। একাকীত্ব থেকে হতাশা, আর হতাশা থেকে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যাচ্ছে। সামাজিক সমর্থন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মানসিক রোগীরা অনেক সময় একা লড়াই করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশে গত ছয় মাসে মানসিক চাপজনিত রোগ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে—অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিক্ষাগত চাপ, সামাজিক পরিবর্তন, ও সীমিত স্বাস্থ্যসেবা। সমাধানের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ—মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, সচেতনতা বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদান এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। অন্যথায়, এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















