০৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
স্যাম্পলের সিম্ফনি: ড্যানিয়েল লোপাটিনের পরীক্ষামূলক সাউন্ডস্কেপের নতুন বিস্তার এআই ভিডিও কমাতে ‘টোন ডাউন’ অপশন আনছে টিকটক রেকর্ড-নতুন ফল: চীনের জুনো ‘ঘোস্ট পার্টিকল’ ডিটেক্টরের অভাবনীয় সাফল্য ডেভনে আবার ফিরতে পারে বন্য বিড়াল: দুই বছরের গবেষণায় নতুন সম্ভাবনা প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২৭) নন-প্রফিট কাঠামোতে যাচ্ছে মাষ্টডন, সিইও পদ ছাড়ছেন প্রতিষ্ঠাতা ইউজেন রখকো” ইউটিউবে রেকর্ড ভিউ, তবু ‘বেবি শার্ক’ নির্মাতার আয় সীমিত কেন” চীনের এআই দৌড়ে তীব্র প্রতিযোগিতা, লোকসানে কেঁপে উঠল বাইদু গোপন সসের নিরাপত্তায় নতুন জোর দিচ্ছে রেইজিং কেইন’স  সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা

হরবতি নদী: দিনাজপুরের দুই শতাব্দীর এক জলধারা

বাংলার নদ-নদী কেবল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নয়, এগুলো আমাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সাহিত্যকে আকার দিয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে দিনাজপুর জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী হলো হরবতি নদী। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই নদী দুই তীরের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য ও মাছ সরবরাহ করেছে, বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে এবং গান, কবিতা ও লোককাহিনীর প্রেরণা জুগিয়েছে। হরবতি নদীর ইতিহাসকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সভ্যতা, বিকশিত হয়েছে জনপদ ও বাজার, আবার সংকটে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

এই প্রতিবেদনে আমরা হরবতি নদীর প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস, সভ্যতা, বন-জঙ্গল, মাছ ও জলজ সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক রপ্তানি-আমদানি, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও লোকগীতি—সব দিক বিশদভাবে আলোচনার চেষ্টা করব।

নদীর জন্ম ও ভৌগোলিক পরিচয়

হরবতি নদীর উৎপত্তি হয়েছিল প্রায় দুই শত বছর আগে, পাহাড়ি ঝরনা ও ছোট ছোট খাল মিলিয়ে। ধীরে ধীরে এ নদী বিস্তৃত হয়ে একদিকে আঞ্চলিক কৃষিকে প্রাণবন্ত করেছে, অন্যদিকে সীমান্তবর্তী বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে। নদীর দুই তীরজুড়ে বিস্তৃত ছিল বনাঞ্চল, যেখানে শাল, গর্জন, মহুয়া, করই ও বাঁশের ঝাড় ঘনভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। নদীর স্রোতের সঙ্গে মিশে যেত ঝরনার শীতলতা, যা গ্রীষ্মকালে শুষ্ক ভূমিতেও শস্য উৎপাদনের সুযোগ করে দিত।

দুই তীরের সভ্যতার বিকাশ

নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছিল কয়েকটি প্রাচীন জনপদ। গ্রামগুলোতে কৃষিই ছিল প্রধান জীবিকা, কিন্তু নদীর কারণে তারা দ্রুত ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। নৌকা চলাচল সহজ হওয়ায় চাল, গম, পাট, আখ ও তিল বাজারে পৌঁছাত দ্রুত। এর ফলে তীরবর্তী গ্রামগুলোতে হাট-বাজার গড়ে ওঠে। হরবতির কোল ঘেঁষে জন্ম নেয় মাটির তৈরি নান্দনিক হস্তশিল্প, যা নদীপথে দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত।

ব্রিটিশ শাসনামলে নদীটির গুরুত্ব আরও বাড়ে। তীরবর্তী অঞ্চলে রাজস্ব সংগ্রহ ও বাজারকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সহজতর করতে ব্রিটিশরা নদীপথ ব্যবহার করত। পরে পাকিস্তান আমলেও নদীটি কৃষিপণ্য পরিবহন ও নৌ-যাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বন ও পরিবেশের প্রভাব

নদীর দুই তীরে প্রাচীনকাল থেকেই বনভূমি ছিল ঘন। এসব বনে বাস করত হরিণ, শিয়াল, বানর, নানান প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ। নদীর জলজ পরিবেশের সঙ্গে বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে নদী নতুন উর্বর পলি নিয়ে আসত, যা তীরবর্তী কৃষিজমিকে উর্বর করত।

তবে সময়ের সঙ্গে বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। মানুষ গাছ কেটে বসতি ও কৃষিজমি বাড়িয়েছে। এর ফলে নদীর পাড় ভাঙন বেড়েছে, জীববৈচিত্র্য কমেছে।

মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্য

হরবতি নদী ছিল মাছের ভাণ্ডার। দুই শতক ধরে এ নদীতে পাওয়া যেত রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, বোয়াল, শোল, টাকি, কই, পুঁটি, চিতলসহ নানা দেশি মাছ। বর্ষাকালে মাছ ধরা হতো চাঁই, জাল ও বড়শি দিয়ে। গ্রামীণ অর্থনীতির বড় একটি অংশ গড়ে উঠেছিল মাছ বিক্রির ওপর।

শুধু মাছ নয়, নদীতে ছিল নানা জলজ প্রাণী যেমন কচ্ছপ, শামুক, ঝিনুক ও ছোট চিংড়ি। এগুলো গ্রামীণ মানুষের পুষ্টি ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখেছে। তবে আধুনিক কালে নদীর জলাশয় দূষিত হওয়ায় এসব মাছের প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে।

যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য

হরবতি নদী দুই শত বছর ধরে আঞ্চলিক যোগাযোগ ও ব্যবসার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নৌকা, ডিঙ্গি, সাম্পান, পরে পালতোলা নৌকা এবং আধুনিক মোটরচালিত নৌযান এই নদী দিয়ে চলত। নদীপথে কৃষিপণ্য বাজারে পাঠানো হতো, আবার লবণ, মশলা, কাপড় ও লোহাজাত দ্রব্য আমদানি হতো।

নদীটির মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশেও রপ্তানি-আমদানি হতো। বিশেষ করে পাট, চাল ও মশলা পার্শ্ববর্তী সীমান্ত দিয়ে রপ্তানি হতো, আর ভারত থেকে আসত লোহা, কাপড় ও মশলা। নদীর ঘাটগুলো হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ছোট ছোট কেন্দ্র।

নদী-বন্দর ও সংযুক্ত নদীপথ

হরবতি নদী একা নয়, এটি যুক্ত ছিল আরও কয়েকটি ছোট-বড় নদীর সঙ্গে। পূর্বে এটি মিলত করতোয়া নদীর সঙ্গে, পশ্চিমে যুক্ত ছিল ছোট ছোট খাল ও বিলের সঙ্গে। এর ফলে নদীপথে যাতায়াত সহজ হতো। তীরবর্তী তিনটি বড় ঘাট—কালীগঞ্জ ঘাট, খলিলপুর ঘাট ও গাবতলি ঘাট—ছিল ব্যবসা ও যাত্রার মূল কেন্দ্র।

সংস্কৃতিসাহিত্য ও লোকসংগীত

হরবতি নদী শুধু অর্থনীতিই নয়, মানুষের সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাটিয়ালি গান, পালাগান ও লোককাহিনী প্রচলিত ছিল। নৌকার মাঝিরা নদীতে বৈঠা চালাতে চালাতে ভাটিয়ালি গাইত—
“নদীর পারে বসে আছি, নাও যাবে কোন পারে।”

এই ভাটিয়ালি গানগুলো হরবতির ঢেউয়ের সঙ্গেই মিশে থাকত। স্থানীয় কবি ও গীতিকাররা নদীকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখেছেন। পল্লীগীতিতে হরবতি নদীর স্রোত, তার রূপ ও বেদনার কাহিনী স্থান পেয়েছে।

এছাড়া বর্ষায় নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে মেলা বসত। সেখানে যাত্রাপালা, বাউলগান, কবিগান হতো। নদীর নাম নিয়েই তৈরি হয়েছিল একাধিক বাউল গান।

সংকট ও পরিবর্তন

গত কয়েক দশকে হরবতি নদীর অবস্থা বদলেছে। বালু উত্তোলন, দূষণ, দখল ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গভীরতা কমেছে। বর্ষায় পানি ভরে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় শুকিয়ে যায়। এতে কৃষি ও মৎস্য চাষে ক্ষতি হচ্ছে।

যে নদী একসময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল, তা এখন স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ। নৌপথের পরিবর্তে সড়ক ও রেলপথ প্রধান হয়ে যাওয়ায় নদীর গুরুত্ব কিছুটা কমেছে। তবু গ্রামীণ মানুষের কাছে হরবতি নদী আজও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সাহিত্য ও আধুনিক প্রভাব

বাংলা সাহিত্যেও হরবতি নদীর ছাপ আছে। স্থানীয় লেখকরা নদীর কোলঘেঁষা গ্রামীণ জীবনের কাহিনী তুলে ধরেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতায় নদী এসেছে জীবনের রূপক হয়ে—কখনও প্রেমের প্রতীক, কখনও বেদনার প্রতীক।

আধুনিক কালে হরবতি নদী নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। পরিবেশবাদীরা নদী রক্ষার আন্দোলন করছেন। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা হচ্ছে নদীর সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে।

হরবতি নদীর ইতিহাস কেবল জলধারা নয়, এটি দুই শতাব্দীর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। এর তীরবর্তী মানুষদের জীবন, তাদের হাসি-কান্না, গান-কবিতা, বাণিজ্য-যোগাযোগ সবই এই নদীকে ঘিরে।

আজ নদী সংকটে পড়লেও হরবতি এখনও আশার প্রতীক। এর দুই তীরের মানুষ জানে—নদী বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে। তাই নদী রক্ষা, পুনর্গঠন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্যাম্পলের সিম্ফনি: ড্যানিয়েল লোপাটিনের পরীক্ষামূলক সাউন্ডস্কেপের নতুন বিস্তার

হরবতি নদী: দিনাজপুরের দুই শতাব্দীর এক জলধারা

০৭:০০:১১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলার নদ-নদী কেবল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নয়, এগুলো আমাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সাহিত্যকে আকার দিয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে দিনাজপুর জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী হলো হরবতি নদী। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই নদী দুই তীরের মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য ও মাছ সরবরাহ করেছে, বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে এবং গান, কবিতা ও লোককাহিনীর প্রেরণা জুগিয়েছে। হরবতি নদীর ইতিহাসকে ঘিরে তৈরি হয়েছে সভ্যতা, বিকশিত হয়েছে জনপদ ও বাজার, আবার সংকটে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

এই প্রতিবেদনে আমরা হরবতি নদীর প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস, সভ্যতা, বন-জঙ্গল, মাছ ও জলজ সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক রপ্তানি-আমদানি, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও লোকগীতি—সব দিক বিশদভাবে আলোচনার চেষ্টা করব।

নদীর জন্ম ও ভৌগোলিক পরিচয়

হরবতি নদীর উৎপত্তি হয়েছিল প্রায় দুই শত বছর আগে, পাহাড়ি ঝরনা ও ছোট ছোট খাল মিলিয়ে। ধীরে ধীরে এ নদী বিস্তৃত হয়ে একদিকে আঞ্চলিক কৃষিকে প্রাণবন্ত করেছে, অন্যদিকে সীমান্তবর্তী বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে। নদীর দুই তীরজুড়ে বিস্তৃত ছিল বনাঞ্চল, যেখানে শাল, গর্জন, মহুয়া, করই ও বাঁশের ঝাড় ঘনভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। নদীর স্রোতের সঙ্গে মিশে যেত ঝরনার শীতলতা, যা গ্রীষ্মকালে শুষ্ক ভূমিতেও শস্য উৎপাদনের সুযোগ করে দিত।

দুই তীরের সভ্যতার বিকাশ

নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছিল কয়েকটি প্রাচীন জনপদ। গ্রামগুলোতে কৃষিই ছিল প্রধান জীবিকা, কিন্তু নদীর কারণে তারা দ্রুত ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। নৌকা চলাচল সহজ হওয়ায় চাল, গম, পাট, আখ ও তিল বাজারে পৌঁছাত দ্রুত। এর ফলে তীরবর্তী গ্রামগুলোতে হাট-বাজার গড়ে ওঠে। হরবতির কোল ঘেঁষে জন্ম নেয় মাটির তৈরি নান্দনিক হস্তশিল্প, যা নদীপথে দূরবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত।

ব্রিটিশ শাসনামলে নদীটির গুরুত্ব আরও বাড়ে। তীরবর্তী অঞ্চলে রাজস্ব সংগ্রহ ও বাজারকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সহজতর করতে ব্রিটিশরা নদীপথ ব্যবহার করত। পরে পাকিস্তান আমলেও নদীটি কৃষিপণ্য পরিবহন ও নৌ-যাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বন ও পরিবেশের প্রভাব

নদীর দুই তীরে প্রাচীনকাল থেকেই বনভূমি ছিল ঘন। এসব বনে বাস করত হরিণ, শিয়াল, বানর, নানান প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ। নদীর জলজ পরিবেশের সঙ্গে বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে নদী নতুন উর্বর পলি নিয়ে আসত, যা তীরবর্তী কৃষিজমিকে উর্বর করত।

তবে সময়ের সঙ্গে বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। মানুষ গাছ কেটে বসতি ও কৃষিজমি বাড়িয়েছে। এর ফলে নদীর পাড় ভাঙন বেড়েছে, জীববৈচিত্র্য কমেছে।

মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্য

হরবতি নদী ছিল মাছের ভাণ্ডার। দুই শতক ধরে এ নদীতে পাওয়া যেত রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, বোয়াল, শোল, টাকি, কই, পুঁটি, চিতলসহ নানা দেশি মাছ। বর্ষাকালে মাছ ধরা হতো চাঁই, জাল ও বড়শি দিয়ে। গ্রামীণ অর্থনীতির বড় একটি অংশ গড়ে উঠেছিল মাছ বিক্রির ওপর।

শুধু মাছ নয়, নদীতে ছিল নানা জলজ প্রাণী যেমন কচ্ছপ, শামুক, ঝিনুক ও ছোট চিংড়ি। এগুলো গ্রামীণ মানুষের পুষ্টি ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখেছে। তবে আধুনিক কালে নদীর জলাশয় দূষিত হওয়ায় এসব মাছের প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে।

যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য

হরবতি নদী দুই শত বছর ধরে আঞ্চলিক যোগাযোগ ও ব্যবসার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নৌকা, ডিঙ্গি, সাম্পান, পরে পালতোলা নৌকা এবং আধুনিক মোটরচালিত নৌযান এই নদী দিয়ে চলত। নদীপথে কৃষিপণ্য বাজারে পাঠানো হতো, আবার লবণ, মশলা, কাপড় ও লোহাজাত দ্রব্য আমদানি হতো।

নদীটির মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশেও রপ্তানি-আমদানি হতো। বিশেষ করে পাট, চাল ও মশলা পার্শ্ববর্তী সীমান্ত দিয়ে রপ্তানি হতো, আর ভারত থেকে আসত লোহা, কাপড় ও মশলা। নদীর ঘাটগুলো হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ছোট ছোট কেন্দ্র।

নদী-বন্দর ও সংযুক্ত নদীপথ

হরবতি নদী একা নয়, এটি যুক্ত ছিল আরও কয়েকটি ছোট-বড় নদীর সঙ্গে। পূর্বে এটি মিলত করতোয়া নদীর সঙ্গে, পশ্চিমে যুক্ত ছিল ছোট ছোট খাল ও বিলের সঙ্গে। এর ফলে নদীপথে যাতায়াত সহজ হতো। তীরবর্তী তিনটি বড় ঘাট—কালীগঞ্জ ঘাট, খলিলপুর ঘাট ও গাবতলি ঘাট—ছিল ব্যবসা ও যাত্রার মূল কেন্দ্র।

সংস্কৃতিসাহিত্য ও লোকসংগীত

হরবতি নদী শুধু অর্থনীতিই নয়, মানুষের সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। তীরবর্তী গ্রামগুলোতে ভাটিয়ালি গান, পালাগান ও লোককাহিনী প্রচলিত ছিল। নৌকার মাঝিরা নদীতে বৈঠা চালাতে চালাতে ভাটিয়ালি গাইত—
“নদীর পারে বসে আছি, নাও যাবে কোন পারে।”

এই ভাটিয়ালি গানগুলো হরবতির ঢেউয়ের সঙ্গেই মিশে থাকত। স্থানীয় কবি ও গীতিকাররা নদীকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখেছেন। পল্লীগীতিতে হরবতি নদীর স্রোত, তার রূপ ও বেদনার কাহিনী স্থান পেয়েছে।

এছাড়া বর্ষায় নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে মেলা বসত। সেখানে যাত্রাপালা, বাউলগান, কবিগান হতো। নদীর নাম নিয়েই তৈরি হয়েছিল একাধিক বাউল গান।

সংকট ও পরিবর্তন

গত কয়েক দশকে হরবতি নদীর অবস্থা বদলেছে। বালু উত্তোলন, দূষণ, দখল ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গভীরতা কমেছে। বর্ষায় পানি ভরে গেলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় শুকিয়ে যায়। এতে কৃষি ও মৎস্য চাষে ক্ষতি হচ্ছে।

যে নদী একসময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল, তা এখন স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ। নৌপথের পরিবর্তে সড়ক ও রেলপথ প্রধান হয়ে যাওয়ায় নদীর গুরুত্ব কিছুটা কমেছে। তবু গ্রামীণ মানুষের কাছে হরবতি নদী আজও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সাহিত্য ও আধুনিক প্রভাব

বাংলা সাহিত্যেও হরবতি নদীর ছাপ আছে। স্থানীয় লেখকরা নদীর কোলঘেঁষা গ্রামীণ জীবনের কাহিনী তুলে ধরেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতায় নদী এসেছে জীবনের রূপক হয়ে—কখনও প্রেমের প্রতীক, কখনও বেদনার প্রতীক।

আধুনিক কালে হরবতি নদী নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। পরিবেশবাদীরা নদী রক্ষার আন্দোলন করছেন। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা হচ্ছে নদীর সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে।

হরবতি নদীর ইতিহাস কেবল জলধারা নয়, এটি দুই শতাব্দীর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। এর তীরবর্তী মানুষদের জীবন, তাদের হাসি-কান্না, গান-কবিতা, বাণিজ্য-যোগাযোগ সবই এই নদীকে ঘিরে।

আজ নদী সংকটে পড়লেও হরবতি এখনও আশার প্রতীক। এর দুই তীরের মানুষ জানে—নদী বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে। তাই নদী রক্ষা, পুনর্গঠন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আজ সময়ের দাবি।