কষ্ট শ্রোত্রিয়-যাহারা কন্যা গ্রহণে ও সম্প্রদানে নিতান্ত অসাবধান, তাহারাই কষ্ট শ্রোত্রিয় হইতেন। এই কষ্ট শ্রোত্রিয়ের ৮৪ গাঁই। ইহাদের মধ্যে ৮ ঘর প্রসিদ্ধ। যথা:-শীহরি, রাইগাঁই, কুড়িমুড়িয়া, গোস্বা, খর্জুরী, বিশি, উচ্চরিক ও জামরিক। স্বর্ণদেব শীহরি গ্রাম প্রাপ্ত হইয়া কষ্ট শ্রোত্রিয় আখ্যা প্রাপ্ত হন। রাইগাঁই রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও দেখা যায়।

ইহাদের মধ্যে কাশ্যপ গোত্রীয় সুষেণের বংশোদ্ভব মৈত্রেয় ও ক্রতু, শাণ্ডিল্য গোত্রীয় নারায়ণ ভট্টের বংশোদ্ভব সাধু, রুদ্র, লোকনাথ’ ও বাৎস্য গোত্রীয় ধরাধরের বংশোদ্ভব লক্ষ্মীধর, জয়মণি মিশ্র, বল্লালের নিকট কৌলীন্যমর্যাদা প্রাপ্ত হন। অবশিষ্ট সমুদয় শ্রোত্রিয় বলিয়া প্রসিদ্ধ হয়।
রাজসাহীতে নাটোর (রাজবংশ), পানশীপাড়া, ইসলামগাঁতি, আটগ্রাম প্রভৃতি স্থানের শ্রোত্রিয় অতি প্রসিদ্ধ।
কোন ব্যক্তির সহিত কোন একটি কন্যার সম্বন্ধ নির্ণয় (করণ) হইবার পর, দৈবাৎ যদি বিরাহের পূর্বেই বরের মৃত্যু হয়, তবে ঐ অবিবাহিতা কন্যাকে অন্যপূর্বা কহে। বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে এই অন্যপূর্বা বিবাহ প্রচলিত আছে বটে; কিন্তু যে ব্রাহ্মণ এই কন্যাকে বিবাহ করে, সে সমাজে অতি ঘৃণিত হইয়া থাকে এবং উৎকৃষ্ট কুলে আদান প্রদান করিতে পারে না। এই দোষ নিবারণ জন্য এক্ষণে বিবাহের অব্যবহিত পূর্বে করণ হয়।
কাপ (কাচ) রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে ক্লাপ নাই। বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে কাপের সৃষ্টি হয়। সাধারণ কথায় কুলভ্রষ্ট ব্যক্তিকে কাপ বলা যায়। শান্তিপুর নিবাসী নৃসিংহ লাডুলি সিদ্ধ শ্রোত্রিয় ছিলেন না। তাহার কন্যাকে কুলীন শ্রেষ্ঠ মধু মৈত্রেয় বিবাহ করিলে, মধুর পূর্ব পত্নীর গর্ভজাত সন্তানগণ, পিতা নীচ বংশের কন্যা গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া তাহাকে পরিত্যাগ করিল এবং বাটির মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া পৃথক বাস করিতে লাগিল। বেঁই বাগচি মৈত্রেয়ের ভগিনীপতি। ধেই বাগচি, তাহার পত্নীর অনুরোধে, মধু মৈত্রের বাটিতে তাহার পিতার একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ উপলক্ষে আসিয়া দেখিলেন, মধুর পুত্রগণ চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া পৃথক বাস করিতেছেন। ধেই বাগচির নানা উপদেশে পুত্রগণ পিতার সহিত একত্রিত হইল না। তৎপর ধেই বাগচি মধুর পুত্রগণকে বলিলেন, তোরা বাটির মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া এ একটি “কাচ” করিয়াছিস্। এই “কাচ” শব্দ হইতে “কাপ” হইল। মধু মৈত্রের প্রথম বনিতার তিন পুত্র রক্ষতাই, নন্দাই, গদাই এই তিন সহোদর কুলভ্রষ্ট কাপ হইলেন। তাহারা বারি-বিন্দু প্রক্ষেপ দ্বারা অন্যেকেও কাপ করিয়া লইতে লাগিল। মধু মৈত্রেয়ও সমাজে পতিত অবস্থায় আছেন। কিন্তু রাজা কংসনারায়ণ মধু মৈত্রকে কন্যা দান করিয়া, তাহার সমাজের মর্যাদা রক্ষা করিলেন, রাজা কংসনারায়ণ শ্রোত্রিয় হইলেন, কিন্তু নৃসিংহ লাজুলির ও রাজা কংসনারায়ণের দৌহিত্রগণ কুলীন পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিলেন। এই সময় হইতে কুশবারি সংযুক্ত না হইলে, কেবল শয়নে, ভোজনে, স্পর্শে, বারি-বিন্দু প্রক্ষেপে কুলীনের কুলপাত হইবে না বলিয়া স্থির হইল। কাপের সহিত শ্রোত্রিয়ের বৈবাহিক সম্বন্ধ হইল, কাপ স্বধর্মে পুষ্ট রহিলেন। এ বিষয় তাহিরপুর ও নাটোর রাজবংশের ইতিহাসে বিস্তারিতরূপে বিবৃত হইবে।
কাপগণের অনেক শাখা। প্রধানত তিন শাখা প্রসিদ্ধ যথা- (১) বারবকাবাদ, (২) সুলতান প্রতাপ, (৩) গঙ্গাতীর। প্রথম দুই শাখা-রাজসাহী প্রদেশের (রাজসাহী ও পাবনা জেলার) অন্তর্গত এবং তৃতীয় শাখা মুরশিদাবাদের অধীন।
(১) হরিপুর, লালুর (লালোর), কাসিমপুর, হাঁসপুর প্রভৃতি স্থানগুলি বারবকাবাদ সমাজের অধীন।
(২) বাক্, কাবারি, কোলা, নয়াবাড়ি, ক্ষেতুপাড়া প্রভৃতি স্থানগুলি সুলতান প্রতাপ সমাজের অধীন।
(৩) খাগড়া, ব্যাসপুর, আচার্যপাড়া প্রভৃতি স্থানগুলি গঙ্গাতীর সমাজের অধীন।
রাজসাহী প্রদেশের কাপ মধ্যে হরিপুর, লালুর, কাসিমপুরের চৌধুরীরা, হাঁসপুরের ভট্টাচার্যেরা, ক্ষেতুপাড়ার রায়েরা এবং কাসিমপুরের লাহিড়িবংশীয়েরা বিশেষ প্রসিদ্ধ। কাপ ক্রমাগত কুলীনে কন্যাদান করিতে পারিলেই কাপের মর্যাদা বৃদ্ধি হইল।
বারেন্দ্র কুলীন ব্রাহ্মহ্মণ কুলভ্রষ্ট হইলে কাপ হন এবং কুলীন বলিয়া আর গৌরব রাখিতে না পারিলেও কুলকার্যদ্বারা সর্বদা তাজা থাকেন; কিন্তু রাঢ়ী কুলীন ব্রাহ্মণ কুল ভঙ্গ করিলে, তিন পুরুষ পর্যন্ত কিয়ৎ পরিমাণে কুলীনের মর্যাদা রক্ষা করিয়াও কুলকার্য দ্বারা আর তাজা থাকিতে পারে না।