আমদানিনির্ভর ফলের সংকট
বর্তমানে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সহজে আপেল ও কমলা কিনতে পারছে না। একসময় মধ্যবিত্ত পরিবারের বাজারে এগুলো নিয়মিত থাকলেও এখন দাম এতটাই বেড়েছে যে মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর মূল কারণ হলো বাংলাদেশ এই ফলগুলোতে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা—সব মিলিয়ে দেশের বাজারে আমদানি করা ফলের দাম দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের পুষ্টির ঘাটতি আরও গভীর হচ্ছে।
দেশীয় ফলের বৈচিত্র্য ও শক্তি
বাংলাদেশের কৃষি ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। দেশের আবহাওয়া ও মাটি এমন যে সারা বছরই কোনো না কোনো ফল উৎপাদন সম্ভব। বিশেষ করে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, আনারস, পেঁপে, আমড়া, জাম, কুল, নারকেল ও লেবু জাতীয় ফল আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোর অনেকগুলো আবার মৌসুমি হলেও কিছু কিছু ফল প্রায় সারা বছর পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এসব ফল শুধু সহজলভ্য নয়, পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষায় কার্যকর।

আম ও কাঁঠাল: জাতির সম্পদ
বাংলাদেশকে আম ও কাঁঠালের দেশ বলা হয়। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত প্রতিটি গ্রামেই আম ও কাঁঠালের গাছ চোখে পড়ে। আমে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অন্যদিকে কাঁঠাল শক্তির ভাণ্ডার এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সস্তা খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি আম ও কাঁঠালের বাণিজ্যিক চাষে আরও প্রণোদনা দেয়, তাহলে দেশের ফল ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ হবে।
কলা ও পেয়ারা: সারা বছরের ফল
কলা ও পেয়ারা এমন দুটি ফল যা প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়। কলা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সহজেই উৎপাদন করা যায়, এমনকি অল্প জমিতেও। এটি সস্তা ও সহজলভ্য শক্তি ও পটাশিয়ামের উৎস। অন্যদিকে পেয়ারা কম খরচে দ্রুত ফলন দেয়। দেশের বরিশাল অঞ্চল পেয়ারা উৎপাদনে ইতিমধ্যেই খ্যাতি অর্জন করেছে। এগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে আরও সম্প্রসারিত করলে দেশীয় ফলের সরবরাহ সারা বছর স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।
আনারস ও পেঁপে: স্বাস্থ্যকর বিকল্প
বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা, বিশেষ করে সিলেট, খাগড়াছড়ি ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে আনারস প্রচুর উৎপাদিত হয়। আনারসে ভিটামিন সি ও ফাইবার থাকে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। পেঁপে হজমে সহায়ক এবং পুষ্টিকর একটি ফল। এগুলোর উৎপাদন বাড়ালে আমদানিনির্ভর ফলের বিকল্প হিসেবে সাধারণ মানুষ সহজেই এগুলো গ্রহণ করতে পারবে।

কম পরিচিত ফলের চাষের সম্ভাবনা
দেশে কিছু ফল আছে যেগুলো তেমন প্রচলিত না হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে চাষ করলে এগুলো বড় বাজার তৈরি করতে পারে। যেমন—ড্রাগন ফল, মালটা, বারি লেবু, কামরাঙ্গা, কুল ও নারকেল। মালটা বা কমলালেবুর দেশীয় জাত ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চলে সফলভাবে চাষ হচ্ছে। এগুলোকে সরকারি সহায়তায় আরও ছড়িয়ে দিলে দেশীয় বাজারে আপেল-কমলার বিকল্প সহজেই তৈরি হবে।
পুষ্টি ঘাটতি পূরণে দেশীয় ফলের গুরুত্ব
বাংলাদেশে এখনও শিশু ও নারীদের মধ্যে ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি বিদ্যমান। যদি দেশীয় ফল উৎপাদন পরিকল্পিতভাবে বাড়ানো যায়, তাহলে প্রোটিননির্ভর খাদ্যের পাশাপাশি ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতিও অনেকটা পূরণ হবে। বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য “এক বেলা এক ফল” কর্মসূচি চালু করা গেলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারবে।
অর্থনৈতিক ও নীতি-পর্যায়ের দিক
দেশীয় ফল চাষ বাড়ালে শুধু পুষ্টি নয়, অর্থনীতিও লাভবান হবে। স্থানীয় বাজারে ফল সরবরাহ বাড়লে আমদানিনির্ভরতা কমবে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। কৃষক সরাসরি লাভবান হবে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিও পর্যায়ে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি।
বাংলাদেশের মানুষের সামনে এখন বড় সুযোগ হলো দেশীয় ফল চাষকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করা। আপেল-কমলার মতো আমদানিনির্ভর ফলের দিকে না তাকিয়ে দেশীয় আম, কাঁঠাল, কলা, পেয়ারা, আনারস ও পেঁপের উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নতুন জাতের মালটা, লেবু ও ড্রাগন ফলকেও সম্প্রসারণ করতে হবে। এতে যেমন সাধারণ মানুষের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হবে, তেমনি দেশীয় কৃষিও শক্তিশালী হবে এবং অর্থনীতি আমদানি-চাপ থেকে মুক্তি পাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















