মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট সম্প্রতি নিক্কেই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুল্কগুলো বরফের টুকরোর মতো গলে যাবে। যদি উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসে, তবে আমদানি কমে আসবে।”
এই বরফের টুকরো উপমাটি বৈশ্বিক কর্পোরেট নির্বাহীদের কাছে আশার সুরের মতো শোনায়। আমরা পরামর্শক হিসেবে প্রায়ই জাপানি কর্পোরেট গ্রাহকদের কাছ থেকে শুনি—মিত্রদেশ যেমন জাপান থেকে আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক, যা ৭ আগস্ট থেকে ১৫% বেস শুল্কে নির্ধারিত, কয়েক বছরের মধ্যে কি উঠে যাবে? তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র-চীন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে চীনা আমদানিতে ভারী শুল্ককে যৌক্তিক মনে করেন, কিন্তু মিত্রদেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ককে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে বলে বিশ্বাস করতে চান না।
কিন্তু এই আশাবাদ ভুল। শুধু চীনের জন্য নয়, বরং মিত্রদের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্কও বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতে যাচ্ছে। এগুলো বরফের টুকরো নয়, বরং হিমবাহ। এগুলো আবার ক্ষমতাভিত্তিক নতুন বৈশ্বিক শৃঙ্খলার উপসর্গ, যা বৈশ্বিক কর্পোরেট নেতৃত্বকে মেনে নিতে হবে এবং যেখানে সম্ভব, প্রভাব খাটানোর পথ খুঁজে নিতে হবে।
গত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর শুল্কহার ৭.৫ গুণ বেড়েছে—প্রায় ১০০ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বেসেন্ট আশ্বস্ত করলেও, শুল্কগুলো স্থায়ী হয়ে যাওয়ার মতো বহু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, এগুলো আসক্তিকর। অল্প সময়ে এগুলো ফেডারেল সরকারের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাহারযোগ্য নয় এমন আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে। বছরের প্রথম সাত মাসে শুল্ক থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে—২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। জুন মাসে এই আয় সরকারের প্রায় এক দশকের মধ্যে প্রথমবার বাজেট উদ্বৃত্ত তৈরি করেছে।

দ্বিতীয়ত, শুল্ক মূল্য বাড়ায়, ভোক্তাদের বিকল্প কমায় এবং প্রবৃদ্ধি কমালেও, এগুলো বিজয়ীও তৈরি করে। যাঁরা উপকৃত হন, তাঁরা শুল্ক প্রত্যাহারের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেবেন, এমনকি এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হলেও।
এর একটি উদাহরণ হলো ১৯৬৪ সালের “চিকেন ট্যাক্স।” ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন মুরগি আমদানিতে শুল্ক বসালে, যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হালকা ট্রাক আমদানিতে ২৫% শুল্ক আরোপ করে। আজও সেই শুল্ক মার্কিন ট্রাক বাজারকে সুরক্ষা দিচ্ছে। যদিও এটি ডেট্রয়েটের গাড়ি নির্মাতাদের লাভজনক নিস তৈরি করেছিল, একইসঙ্গে এশীয় ব্র্যান্ডের ছোট ও দক্ষ ট্রাকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের আত্মতুষ্টও করে তোলে। এই ঘটনা দেখায়, বাণিজ্য বাধা দীর্ঘমেয়াদে বিকৃতি তৈরি করে।
তৃতীয়ত, ভূরাজনৈতিক কারণে শুল্ক আরও শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এখন বাণিজ্য প্রকাশ্যে ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। শুধু যুক্তরাষ্ট্র-চীন নয়, ইউরোপ বা ভারতের ক্ষেত্রেও শুল্ককে দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—যেমন ভারতকে রুশ জ্বালানি না কিনতে বাধ্য করার জন্য হুমকি দেওয়া।
ক্ষমতাভিত্তিক বৈশ্বিক শৃঙ্খলায়, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে শুল্ককে অস্ত্রে পরিণত করছে, তা অন্যরা অনুকরণ করবে। এমনকি আদালত যদি সরকারের শুল্ক আরোপের আইনি ভিত্তি সীমিত করে, তাহলেও প্রশাসন দেখিয়েছে “জাতীয় নিরাপত্তা”র সংজ্ঞা প্রসারিত করে বুলডোজার থেকে শুরু করে শিশুদের স্ট্রলার পর্যন্ত সবকিছু শুল্কের আওতায় আনতে পারে।
অতএব, শুল্ক টিকে থাকার মানে হলো—বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে উন্মুক্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেছিল, তা আর নেই। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম হলেও একমাত্র হবে না। এর অর্থনৈতিক পরিণতি গুরুতর হবে।
অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের একটি পূর্বাভাস অনুযায়ী, “বিভক্ত বিশ্বে” ২০৪০-এর দশকে বৈশ্বিক গড় মুদ্রাস্ফীতি ২.৭% থেকে বেড়ে ৪% হতে পারে এবং প্রবৃদ্ধি ২% থেকে নেমে ১.২%-এ ঠেকতে পারে।
তাহলে কি ব্যবসায়ীরা অসহায় যাত্রী মাত্র? আমরা মনে করি, মোটেই নয়। পৃথকভাবে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারে এবং সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়তে পারে।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে, ব্যবসাগুলোকে তাদের কার্যক্রমে শুল্ক সহনশীল হতে হবে। যেমন মুদ্রার ওঠানামা, বিধিবিধানের উল্টোপাল্টা বা জলবায়ু সংকটের মতো শুল্কও কর্পোরেট কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় শুল্ক আরও ঘন ঘন পরিবর্তিত হবে। তাই শুল্ক সহনশীলতা গড়ে তোলা এখনকার নির্বাহীদের জন্য এক নতুন দক্ষতা।
শুল্ক সহনশীলতা মানে হলো—স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে নীতিগত ধাক্কার প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা। যেমন মুদ্রার চাপ শুল্ক খরচকে সমন্বয় করতে পারে বা পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তা আরও বাড়াতে পারে। এর জন্য ব্যয়বহুল বিকল্প পরিকল্পনা ও গতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য দরকার।
জাপানি নির্মাতারা ইতিমধ্যে এই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিচ্ছে। ফুজিকুরা কোম্পানির সিইও নাওকি ওকাদা নিক্কেইকে বলেন, ডলারের বিপরীতে ইয়েন ১০ ইয়েন অবমূল্যায়িত হলে এর ইতিবাচক প্রভাব বেস শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবের চেয়েও বেশি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফুজিকুরা তাদের বিশেষ অপটিক্যাল ফাইবারের মতো অনন্য পণ্যের দাম বাড়াতে পারে, যা গ্রাহকদের ওপর শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেয়।
যেসব কোম্পানি মানিয়ে নিতে পারে, তাদের জন্য শুল্ক উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতার উন্নতি ঘটাতে পারে।
সময় গড়ালে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন নতুন বাস্তবতায় নিজেদের সাজিয়ে নেবে। বিশ্ব বাণিজ্যের “সবচেয়ে অনুকূল দেশ” মর্যাদা ক্ষয়ে যাওয়ায় নতুন বাণিজ্যব্যবস্থা জটিল ও খণ্ডিত হবে। তবে তা একেবারে বিশৃঙ্খল হবে না, আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নতুন নিয়মে সুযোগ খুঁজে নেবে।
সব খবরই খারাপ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যখন ভেতরমুখী হবে, তখন আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটগুলো নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেতে পারে। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সিপিটিপিপি জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি—যা ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক এলাকায় শুল্ক কমানো ও বিধিবিধান সমন্বিত করার পথ দেখায়। জুলাইয়ের ইইউ-জাপান সম্মেলনে নতুন প্রতিযোগিতা জোট চালু হয়েছে, যা বিরল খনিজের যৌথ ক্রয়ের ওপর জোর দিয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপ এশিয়ার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন বাজার দখল ও সাপ্লাই চেইনের স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হবে।

যদিও পৃথকভাবে ব্যবসাগুলোকে টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে, তবু তাদের সম্মিলিত শক্তিও প্রয়োগ করতে হবে। মুক্ত বাণিজ্য কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়—এটি পুঁজিবাদের মূলনীতি। উন্মুক্ত বাজার আকার ও বিশেষায়নকে বাড়িয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রসারিত করে। অতীতে ব্যবসায়ীরা বিশ্বায়নের ঢেউয়ে ভেসেছিল; এখন তাদের সচেতনভাবে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হবে—শুধু মানিয়ে নেওয়া নয়, বরং মুক্ততার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
এই কারণ কেবল অর্থনীতির নয়, ইতিহাসও বলে—দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বর্জন বিচ্ছিন্নতার বোধ তৈরি করে এবং সামরিক সংঘাতে অবদান রাখে। জাপানের যুদ্ধকালীন বয়ানে বলা হয়, মার্কিন তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ তাদের আগ্রাসনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তাই নতুন বিশ্বব্যবস্থা যদি নিয়ন্ত্রণহীন থাকে, তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
অতএব, শুল্ককে বরফের টুকরো নয়, বরং নতুন ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। এর মানে হবে নিম্ন প্রবৃদ্ধি, স্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং খণ্ডিতকরণের দিকে ধাবিত হওয়া—যা ইতিহাস প্রমাণ করে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ব্যবসায়ীদের আর দর্শক হয়ে থাকার সুযোগ নেই; তাদের নিজেদের ক্ষমতা চিনতে হবে এবং উন্মুক্ততা ও স্থিতিশীলতার দিকে ধারা ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: নোবুকো কোবায়াশি বৈশ্বিক কৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইওয়াই-পার্থেননের জাপান কনজিউমার প্র্যাকটিসের সহনেতৃত্বে আছেন। কাইল লসলেস ইওয়াই রিস্ক কনসালটিং-এ কাজ করেন, যেখানে তাঁর মূল কাজের ক্ষেত্র কৌশলগত ঝুঁকি ও স্থিতিস্থাপকতায়।
নোবুকো কোবায়াশি ও কাইল লসলেস 


















