করুণ একটি বিকেল
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুর ইউনিয়নের জেএমজি সেকেন্ডারি স্কুল। সোমবারের টিফিন বিরতিতে সাধারণ দিনের মতোই শিক্ষার্থীরা আড্ডা আর হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ক্লাসরুমের ভেতরে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিনা খাতুন (১৩) সবার অগোচরে বিষপান করেন। হাসপাতালে নেয়া হলেও, শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার দুপুরে তার মৃত্যু হয়।
পারিবারিক চাপের কাছে পরাজিত
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিনা খাতুন স্কুলের এক সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। পরিবার যখন বিষয়টি জানতে পারে, তখন তারা বকাঝকা করে। এক কিশোরী মেয়ের জন্য এই ধরণের চাপ ও ভর্ৎসনা সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম নান্নু বলেন, “পারিবারিক চাপের কারণে বিনা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তার এই সিদ্ধান্ত আমাদের সবার জন্যই বেদনাদায়ক।”

কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট
বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এখনও সীমিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৈশোর হলো এক ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ সময়কাল। প্রেম, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক প্রত্যাশা কিংবা সামাজিক বন্ধন—সবকিছুই তাদের ভেতরে তীব্র মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ জানান, “প্রায়ই আমরা দেখি, পরিবারের বকাঝকা বা সম্পর্কের টানাপড়েন কিশোরদের জন্য বড় আঘাত হয়ে দাঁড়ায়। তারা সমস্যার সমাধান দেখতে না পেয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।”
সমাজে লুকিয়ে থাকা নীরব যন্ত্রণা
গ্রামীণ সমাজে প্রেম বা সম্পর্ককে এখনও নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য সামাজিক চাপ দ্বিগুণ। অনেকে পরিবারের ভয় বা সমাজের প্রতিক্রিয়ার কারণে নিজেদের কথা খুলে বলতে পারে না। বিনা খাতুনের মতো অনেক কিশোরী নীরবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে।
একজন স্থানীয় অভিভাবক বলেন, “আমরা সন্তানদের সাথে খোলামেলা কথা বলি না। তারা যদি কোনো ভুল করে, তখন শুধু বকাঝকা করি। ফলে তারা নিজেদের একাকী মনে করে।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কোথায়?
বিদ্যালয় শুধু পড়াশোনার স্থান নয়, বরং শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশেরও একটি জায়গা। শিক্ষকদের অনেক সময়ই ছাত্রছাত্রীদের ভেতরের দুশ্চিন্তা বোঝার সুযোগ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশিরভাগ স্কুলেই নেই পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং ব্যবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা যাতে মানসিক সংকটে পড়লে গোপনে সহায়তা নিতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে কী করা দরকার
বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরছেন—
পরিবারের সহমর্মিতা: সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। শুধু শাসন নয়, তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা।
বিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা: শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার জন্য আলাদা পরামর্শক নিয়োগ করা।
সামাজিক সচেতনতা: প্রেম বা সম্পর্কের মতো বিষয়কে শুধুই নেতিবাচক না দেখে, কিশোরদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে বিবেচনা করা।
খোলামেলা আলোচনা: আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লজ্জা না করে খোলামেলা আলোচনা শুরু করা।
এক অনির্বচনীয় ক্ষতি
মাত্র ১৩ বছরের এক মেয়ের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারেরই নয়, বরং গোটা সমাজের জন্য বড় আঘাত। বিনা খাতুনের চলে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে এখনই নজর দেওয়া জরুরি। না হলে আরও কত স্বপ্ন অকালেই নিভে যাবে, তা কেবল সময়ই বলে দেবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















