বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে প্রবাহিত পানগুচি নদী সেই নদীমাতৃকতার অন্যতম প্রতীক। এ নদী শুধু ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পানগুচি নদী স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্বাহ, বাণিজ্যিক কার্যক্রম, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান অবলম্বন হিসেবে কাজ করেছে।
ভূগোল ও অবস্থান
পানগুচি নদী মোরেলগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে সুন্দরবনের সীমানার সঙ্গে মিশেছে। এটি বলেশ্বর ও ভৈরব নদীর সঙ্গে সংযুক্ত এবং নদীটির শাখা-প্রশাখা স্থানীয় গ্রামীণ জনপদের প্রতিটি অংশকে জলপথে যুক্ত করেছে। এই নদীর জোয়ার-ভাটা সরাসরি স্থানীয় কৃষি, মাছ চাষ ও নৌযান চলাচলে প্রভাব ফেলে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ঔপনিবেশিক আমল থেকে পানগুচি নদী ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুপরিচিত ছিল। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে পালতোলা নৌকা ও বড় বড় স্টিমার এসে মোরেলগঞ্জে নোঙ্গর করত। স্থানীয় কৃষকরা ধান, সুপারি, নারকেল, পাট ও অন্যান্য পণ্য নদীপথে পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাত। পানগুচি নদীর ঘাটগুলো একসময় নৌবাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল, যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জাহাজ, পালতোলা নৌকা আর কাঠের লঞ্চের আনাগোনা লেগে থাকত।

পরিবহন ও যোগাযোগ
সড়ক যোগাযোগ সীমিত থাকায় মোরেলগঞ্জবাসীর প্রধান ভরসা ছিল এই নদী। লঞ্চ, নৌকা, ট্রলার ছিল মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। আজও মোরেলগঞ্জ থেকে বাগেরহাট, পিরোজপুর কিংবা বরিশাল মুখী যাত্রী ও পণ্যবাহী লঞ্চ ও ট্রলার নদীপথে চলে। যদিও সড়ক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছে, তবু গ্রামীণ মানুষ এখনো নিত্যদিনের বাজার-সদাই বা কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য নদীর ওপর নির্ভর করে।
অর্থনীতি ও জীবিকা
পানগুচি নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা অগণিত। এ নদী মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত, যেখানে ইলিশ, চিংড়ি, কাতলা, রুই, তেলাপিয়া প্রভৃতি মাছ ধরা হয়। স্থানীয় জেলেরা নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং মোরেলগঞ্জ বাজারে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মাছ সরবরাহ হয়। শুধু মাছ ধরাই নয়, নদীপথ দিয়ে কাঠ, ইট, ধান, সবজি ও অন্যান্য পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ আয়ের পথ খুঁজে নিয়েছে।
প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য
পানগুচি নদীর পানি ও তীরবর্তী বনভূমি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। গোলপাতা, কেওড়া, বাইনসহ নানা বনজ গাছ নদীর দুই তীরে জন্মে। পাখির কিচিরমিচির, নৌকার বৈঠার শব্দ, আর ভোরের কুয়াশার চাদরে মোড়া নদীর দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। এ নদী শুধু মানুষের জীবন নয়, পাখি, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীরও জীবনধারণের উৎস।

সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পানগুচি
বাংলার লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যেও নদীর উপস্থিতি অনিবার্য। পানগুচি নদী স্থানীয় কবিতা, গান ও লোককথায় স্থান করে নিয়েছে। গ্রামীণ গানের আসরে কিংবা বিয়ের গীত-সংগীতে নদীর নাম উঠে আসে জীবিকার প্রতীক হিসেবে। বর্ষায় নদীর টইটুম্বুর জলে ভেসে বেড়ানো নৌকা গ্রামীণ প্রেমের কাব্যে রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা (কাল্পনিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক বর্ণনা)
মোরেলগঞ্জের প্রবীণ বাসিন্দা হাজী আব্দুল করিম বললেন, “আমরা ছোটবেলায় দেখেছি পানগুচি নদীতে বড় বড় লঞ্চ আসত। তখনকার দিনে নদীই ছিল আমাদের হাট-বাজার আর জীবনযাত্রার একমাত্র ভরসা।”
অন্যদিকে স্থানীয় এক জেলে হাশেম আলী জানালেন, “এখনো আমাদের সংসার চলে নদীর মাছ ধরে। কিন্তু নদী যেমন আগের মতো গভীর নেই, তেমনি মাছও কমে গেছে।”

বর্তমান সংকট
বর্তমানে পানগুচি নদী মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি। একদিকে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে নদীর তীর দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে। স্থানীয় শিল্প-কারখানা ও বাজারের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে, নদীর তীর ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।
উন্নয়ন ও সংরক্ষণ
পানগুচি নদীকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ খননকাজ, অবৈধ দখল মুক্তকরণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ। নদীভিত্তিক জীবিকার টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। যদি নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা যায়, তবে মোরেলগঞ্জসহ সমগ্র বাগেরহাটের অর্থনীতি নতুন প্রাণ পাবে।
পানগুচি নদী শুধু একটি নদী নয়, বরং মোরেলগঞ্জের মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা জীবনরেখা। ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশ—সবকিছুতেই এর ছাপ বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমান সংকট মোকাবিলা করে নদীকে পুনরুজ্জীবিত না করলে এটি হারিয়ে যাবে অতীতের স্মৃতিতে। তাই আজই প্রয়োজন নদীর প্রতি দায়িত্বশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ পরিকল্পনা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















