বাংলাদেশে শিশুবিবাহ (Child Marriage) বহু দশক ধরে একটি সামাজিক ও মানবাধিকার সংকট। আইনে নিষিদ্ধ হলেও গ্রামের গভীরে বা শহরের প্রান্তে এই প্রবণতা অব্যাহত আছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউ, প্রশাসনিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক চাপ — সব মিলিয়ে শিশুবিবাহ নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে।

বর্তমান পরিস্থিতি: পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের (UNICEF) ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৫১ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়। এটি এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ হার। এছাড়া, ১৫ বছরের আগেই ১৫ শতাংশ মেয়ে বিবাহিত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে শিশুবিবাহের হার ছিল ৩০ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪১ শতাংশে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, সমস্যাটি কেবল টিকে আছে তা-ই নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে।

কেন শিশুবিবাহ চলছে
দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক চাপ
অধিকাংশ পরিবার মনে করে, মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিলে খরচ কম হবে, যৌতুকের চাপও কমবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় আয়-রোজগার কমে গেলে পরিবারগুলো মেয়েদের বিবাহকে “অর্থনৈতিক দায়মুক্তি” হিসেবে দেখে।

শিক্ষার সীমাবদ্ধতা
প্রতিটি অতিরিক্ত শিক্ষাবর্ষ শিশুবিবাহের ঝুঁকি প্রায় ৬ শতাংশ কমায়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা, পরীক্ষার অনিয়মিত আয়োজন, এবং শিক্ষকের অভাব মেয়েদের শিক্ষার ধারাবাহিকতায় ভাঙন ঘটায়। এই ভাঙন শিশুবিবাহকে ত্বরান্বিত করে।
সামাজিক রীতি ও নিরাপত্তাহীনতা
গ্রামীণ সমাজে এখনো “মেয়েকে ঘরে রাখা বিপদজনক।” এই ধারণা দৃঢ়। রাজনৈতিক সহিংসতা বা নির্বাচনী অস্থিরতার সময় মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যায়। অনেক অভিভাবক মনে করেন, মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিলে সমাজে সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষা পাবে।

রাজনৈতিক পরিবর্তন: কীভাবে শিশুবিবাহ প্রভাবিত হচ্ছে
গত বছরের বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রশাসনিক কাঠামোতে একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়।
- প্রশাসনিক নজরদারির দুর্বলতা:আগে ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় প্রশাসন বিয়েতে হস্তক্ষেপ করত। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর স্থানীয় তদারকি দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে গ্রামে গোপন বিয়ে বেড়েছে।
- আইনের প্রয়োগে ঢিলেঢালা মনোভাব:রাজনৈতিক রদবদলের কারণে আইনের কঠোরতা শিথিল হয়েছে। ২০১৭ সালের শিশুবিবাহ নিরোধ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন অনীহা বা অক্ষমতা দেখাচ্ছে।
- অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি:রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় অনেক পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ সংকট আবার মেয়েদের আগেভাগে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়াচ্ছে।
- শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাঘাত:রাজনৈতিক সংঘাত বা ধর্মঘটের কারণে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে কিশোরীদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়। তাদের অনেকেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, এবং পরিবার তাদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়।
অতএব, রাজনৈতিক পরিবর্তন শিশুবিবাহের প্রবণতাকে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

শিশুবিবাহের পরিণতি
- স্বাস্থ্যঝুঁকি:অল্প বয়সে গর্ভধারণ মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
- শিক্ষা ও কর্মজীবন:বিয়ে হওয়া মেয়েরা প্রায়ই শিক্ষা বন্ধ করে দেয়, ফলে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান সীমিত হয়।
- দারিদ্র্যের চক্র:স্বল্পশিক্ষিত মেয়ে পরিবারে দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারে না। সমাজে বৈষম্য ও অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- সামাজিক অস্থিরতা:রাজনৈতিক পরিবর্তনের মতোই শিশুবিবাহ সমাজে আরও একধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করে, কারণ এটি নারী অধিকার ও মানবসম্পদ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
গ্রামীণ কেস স্টাডি
উপকূলীয় গ্রাম
সাতক্ষীরার এক গ্রামে সাম্প্রতিক বন্যার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় ১৪ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। পরিবার মনে করে, প্রশাসন এখন ব্যস্ত অন্য বিষয়ে। কেউ বাধা দেবে না।

মধ্যাঞ্চলের রাজনৈতিক সহিংসতা
রাজনৈতিক সংঘর্ষে স্কুল কয়েক মাস বন্ধ থাকায় কিশোরীরা ঘরে বন্দি হয়ে পড়ে। অভিভাবকরা “মেয়ের নিরাপত্তা”র যুক্তি দেখিয়ে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়।
করণীয়
কঠোর আইন প্রয়োগ: রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় আইনের প্রয়োগে ঢিলেঢালা মনোভাব এড়াতে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং বাড়াতে হবে।
শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা: রাজনৈতিক সহিংসতার সময়ও স্কুল বন্ধ না করে বিকল্প শিক্ষা চালু রাখতে হবে।
সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবারকে বোঝাতে হবে যে শিশুবিবাহ নিরাপত্তা নয়, বরং ঝুঁকি বাড়ায়।
অর্থনৈতিক সহায়তা: রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নগদ সহায়তা ও খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে মেয়েদের স্কুলে রাখতে উৎসাহিত করতে হবে।

বাংলাদেশে শিশুবিবাহ একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা, কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। নজরদারি দুর্বলতা, শিক্ষায় ব্যাঘাত, অর্থনৈতিক সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতা — সব মিলিয়ে শিশুবিবাহের ঝুঁকি বাড়ছে।
তবে সমন্বিত পদক্ষেপ — দৃঢ় আইন প্রয়োগ, শিক্ষায় বিনিয়োগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে — এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে শিশুবিবাহ রোধ কেবল মানবাধিকার নয়, বরং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















