বাংলাদেশে স্বর্ণ একদিকে যেমন বিলাসী অলঙ্কার, অন্যদিকে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিন স্বর্ণের দাম বাড়ছে, যা সাধারণ ক্রেতাদের জন্য একধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে। ঢাকার স্বর্ণকার সমিতি প্রতিদিন নতুন দামের তালিকা প্রকাশ করছে, আর প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে রেকর্ড ভাঙার ইতিহাস। কেন এমন হচ্ছে? স্বর্ণের এই অস্থিরতা কি কেবল আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব, নাকি এর পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটও জড়িত?
বৈশ্বিক বাজারের প্রভাব
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম ওঠানামা সব সময়ই স্থানীয় বাজারকে প্রভাবিত করে। আন্তর্জাতিকভাবে ডলার শক্তিশালী হলে বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণে ঝুঁকেন। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার পরিবর্তন — এসবই স্বর্ণকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম যতক্ষণ অস্থির থাকবে, বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলো সরাসরি প্রভাবিত হবে। আমাদের মুদ্রার দুর্বলতা এই চাপকে আরও বাড়িয়ে দেয়।”
ডলার সংকট ও আমদানি খরচ
বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট হলো ডলার ঘাটতি। স্বর্ণ আনতে হলে ব্যবসায়ীদের ডলার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে যারা ডলার পাচ্ছেন, তাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস – BAJUS) এক নেতা বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে বেশি দামে স্বর্ণ আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ ডলারের সরবরাহ সীমিত এবং এলসি খোলার প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে। এই অতিরিক্ত ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ছে।”
অতিরিক্ত চাহিদা ও ভোক্তাদের আচরণ
বাংলাদেশে বিয়ে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উৎসব কিংবা উপহারের ক্ষেত্রে স্বর্ণের চাহিদা অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে বিনিয়োগকারীরাও নগদ অর্থের পরিবর্তে স্বর্ণ কিনে রাখছেন। তারা মনে করছেন, টাকা ব্যাংকে রাখলে মুদ্রাস্ফীতিতে ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু স্বর্ণ কিনে রাখলে অন্তত সম্পদের মান অক্ষুণ্ণ থাকে।
রাজশাহীর এক মধ্যবিত্ত পরিবারপ্রধান জানান, “আমরা মেয়ের বিয়ের জন্য আগেভাগে স্বর্ণ কিনতে চাইছিলাম। কিন্তু প্রতিদিন দাম বাড়ছে দেখে কী করব বুঝতে পারছি না। আজ কিনব নাকি কাল, সেটাই ঠিক করতে পারছি না।”
কৃত্রিম সংকটের অভিযোগ
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল আন্তর্জাতিক কারণেই স্বর্ণের দাম এত দ্রুত বাড়ছে না। দেশের অভ্যন্তরেও একধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী সীমিত সরবরাহের সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য বলেন, “আমরা মনে করি কিছু বড় আমদানিকারক মজুতদারির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।”
মুদ্রাস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে ভুগছেন। এর সঙ্গে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি নতুন চাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো, যারা সামাজিক রীতিনীতির কারণে বিয়েতে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে স্বর্ণ ব্যবহার করতে বাধ্য, তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছেন।
নারায়ণগঞ্জের এক গার্মেন্টস কর্মী অভিযোগ করেন, “আগে সামান্য কষ্ট করে হলেও একটা গলার হার কেনা যেত। এখন স্বপ্নই মনে হয়। আমাদের মতো মানুষরা তো স্বর্ণের বাজার থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছি।”
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির পেছনে তিনটি মূল কারণ কাজ করছে:
আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা – বৈশ্বিক সংকট ও যুদ্ধ পরিস্থিতি।
ডলার ঘাটতি – আমদানি প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত খরচ।
দেশীয় বাজারে চাহিদা ও কৃত্রিম সংকট – সামাজিক প্রয়োজন ও ব্যবসায়িক কৌশল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন মনে করেন, “যতদিন ডলার সংকট থাকবে, ততদিন স্বর্ণের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর নজরদারি জরুরি।”
ব্যবসায়ীদের অবস্থান
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা অবশ্য দাবি করছেন, তারা পরিস্থিতির শিকার। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে দাম বাড়াতে হচ্ছে। তবে অনেক ব্যবসায়ী আবার মনে করেন, প্রতিদিনের এই অস্থিরতা তাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ ক্রেতা হারিয়ে গেলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
ঢাকার নবাবপুরের একজন স্বর্ণকার বলেন, “এখন হয়তো আমরা বেশি দামে বিক্রি করছি। কিন্তু প্রতিদিন ক্রেতা কমছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, দোকান চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে।”
সরকারের ভূমিকা ও সম্ভাব্য সমাধান
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা একমত যে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতি সহজ হবে না। বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সমাধানের দিক নির্দেশ করেছেন —
- ডলার সরবরাহ বাড়ানো:রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি প্রবাসী আয় বাড়াতে উৎসাহ দেওয়া।
- আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করা:এলসি খোলার জটিলতা কমানো।
- বাজারে নজরদারি:কৃত্রিম সংকট রোধে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ।
- ভোক্তা সচেতনতা:বিকল্প ধাতু ব্যবহারের প্রচলন বৃদ্ধি।
বাংলাদেশে প্রতিদিন স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক ও দেশীয় উভয় কারণ কাজ করছে। বিশ্ববাজারের অস্থিরতা, ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ কৃত্রিম সংকট সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে সোনার অলঙ্কার, যা কেবল পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদার ক্ষেত্রেই নয়, পুরো অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সরকারের নীতিগত উদ্যোগ, ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং ভোক্তাদের সচেতনতা — এই তিনটি উপাদানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নইলে স্বর্ণ সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।