বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন— সবক্ষেত্রেই ছাত্ররাজনীতি ছিল এক অনন্য শক্তি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্ররাজনীতির ভেতরে একটি নতুন প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে—র্যাডিকেল মৌলবাদী বা চরমপন্থী ধারার প্রভাব বৃদ্ধি। এর ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ কমছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
র্যাডিকেল প্রভাব ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ
চরমপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরেও তাদের অবস্থান শক্ত করছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী রূপান্তর করা। এতে করে শুধু মুক্ত চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয় না, বরং নারীশিক্ষার উপরে সম্ভাব্য হুমকি তৈরি হয়। কারণ মৌলবাদী রাজনীতি নারীদের শিক্ষা, স্বাধীনতা ও নেতৃত্বকে সীমিত করার প্রবণতা রাখে।
নারীশিক্ষার সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশে গত তিন দশকে নারীশিক্ষা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে বেশি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু যদি ছাত্ররাজনীতিতে মৌলবাদী শক্তি দীর্ঘমেয়াদে আধিপত্য বিস্তার করে, তবে কয়েকটি সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে—

ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা: মৌলবাদী গোষ্ঠী নারী শিক্ষার্থীদের চলাফেরা, পোশাক বা মতপ্রকাশে নিয়ন্ত্রণ চাপানোর চেষ্টা করতে পারে। এতে মেয়েদের অংশগ্রহণ কমবে।
নীতি-প্রভাব: শিক্ষা নীতিতে ধর্মীয় ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়া হলে মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট বিষয় বা ক্ষেত্র সীমিত হতে পারে।
অভিভাবকের ভীতি: সামাজিক চাপ ও নিরাপত্তা সংকটের কারণে অনেক পরিবার মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় পাঠানো থেকে বিরত থাকতে পারে।
নারী নেতৃত্বে বাধা: বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র সংগঠনে নারী নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা সামগ্রিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে ব্যাহত করবে।
বাস্তব উদাহরণ ও অভিজ্ঞতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা হলো— “ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিলে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিলে কিছু গোষ্ঠীর কাছ থেকে কটুক্তি শুনতে হয়। তারা মনে করে মেয়েদের এসব কর্মকাণ্ড ‘অশোভন’। এতে ভয়ের কারণে অনেকে ধীরে ধীরে অংশগ্রহণ কমিয়ে দেয়।”
একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী বলেন, “আমরা চাই পড়াশোনা ও সংগঠনে সমানভাবে কাজ করতে। কিন্তু ক্যাম্পাসে কিছু র্যাডিকেল গোষ্ঠী নারীদের নেতৃত্ব নেওয়াকে মোটেই পছন্দ করে না।”
শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক মহলেও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এক শিক্ষক মন্তব্য করেন, “যদি মৌলবাদী প্রভাব বাড়তে থাকে, তবে নারীশিক্ষার অর্জনগুলো বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। সমাজের অগ্রগতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

সমাজ ও অর্থনীতিতে প্রভাব
নারীশিক্ষার সংকোচন শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, জাতীয় উন্নয়নকেও ব্যাহত করবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নেতৃত্বে নারীর অবদান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যদি এ অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে নারীপুরুষ বৈষম্য বাড়বে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনও কঠিন হয়ে পড়বে।
করণীয়
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি—
- বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তচিন্তা,গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করা।
- নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
- রাজনৈতিক দলগুলোকে মৌলবাদী অ্যাজেন্ডা থেকে দূরে রাখতে সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকা বাড়ানো।
- সরকার ও শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারীশিক্ষা প্রসারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার বজায় রাখা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীশিক্ষা সবসময়ই সামাজিক অগ্রগতির প্রতীক। র্যাডিকেল মৌলবাদী প্রভাব যদি ছাত্ররাজনীতিতে প্রধান ধারা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা নারীশিক্ষার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন— শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রগতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে নারীরা সমান সুযোগ নিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণে অংশ নিতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















