২) ক্ষত্রিয়-পৌরাণিক মতে ইহারা ব্রহ্মার বাহু হইতে জাত হয় বলিয়া ব্রাহ্মণের নীচে ও অন্যান্য বর্ণের উপরিভাগে আসন প্রাপ্ত হন। পুরাকালে এই জাতিই রাজা এবং যুদ্ধব্যবসায়ী ছিল। পরশুরাম পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেন। ইহার পর কোন কোন ক্ষত্রিয়পত্নীরা বংশরক্ষার্থে ব্রাহ্মণগণ দ্বারা সন্তান উৎপাদন করিয়া লন। এই ব্রাহ্মণ ঔরসজাত ক্ষত্রিয়গণ ভ্রষ্ট ক্ষত্রিয় বলিয়া কথিত। এইরূপ ক্ষত্রিয় ভিন্ন প্রকৃত ক্ষত্রিয়ের ঔরসজাত ক্ষত্রিয় অতিবিরল। রাজসাহী জেলায় যাহাদের ক্ষত্রিয় বলা যায়, তাহারা দুই কি তিন শতের বেশি হইবে না। ইহারা পশ্চিম ভারত হইতে আসিয়া এ জেলায় বাস করে। ইহাদের অধিকাংশ ধনী মহাজন। ক্ষত্রিয়ের ঔরসে ও বৈশ্যাণীর গর্ভে যে পুত্র জন্মে, তাহাকে “রাজপুত” বলে। রাজপুত ও ঘাটওয়াল বর্তমান ক্ষত্রিয় জাতির অন্তর্ভূত বলিয়া কেহ কেহ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। এই জেলায় “রাজপুতের” সংখ্যা প্রায় ১৫০০ বা ১৬০০ হইবে। ইহারা প্রায়ই দ্বারবানের কার্য করে। “ঘাটওয়ালের” সংখ্যা প্রায় ২০০ হইবে। ইহারা প্রায়ই চৌকিদারের কার্য নির্বাহ করে।
(৩) বৈশ্য-পৌরাণিক মতে এই জাতি ব্রহ্মার উরু হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। ইহারা দ্বিজ বলিয়া কথিত ছিল। ইহাদের জাতীয় ব্যবসা কৃষি, বাণিজ্য ও কুশীদব্যবহার। বঙ্গদেশীয় বৈশ্যগণের শূদ্রের ন্যায় আচার ব্যবহার। বঙ্গে প্রকৃত বৈশ্য অতি বিরল। মাড়ওয়ারী এই জাতির অন্তর্গত বলিয়া পরিচিত, কিন্তু মাড়ওয়ারীরা নিজে ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকে। রামপুরবোয়ালিয়াতে কতকগুলি মাড়ওয়ারী ব্যবসা বাণিজ্য জন্য বাস করে। ইহাদের সংখ্যা ২০০ কি ২৫০ মাত্র হইবে।
(৪) বৈদ্য-ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এই চারি বর্ণ ব্যতীত পঞ্চম বর্ণ নাই। ইহা ব্যতীত সকল জাতি সঙ্কর জাতি বলিয়া পরিচিত। স্কন্দ পুরাণ-মতে অম্বাকুলোদ্ভব বৈশ্যকন্যা বীরভদ্রার গর্ভে বেদমন্ত্রের বলে ধন্বন্তরি জন্মগ্রহণ করেন। বেদমন্ত্রবলে বালকের জন্ম হয়
বলিয়া “বৈদ্য” এবং অম্বাকুলে জন্ম হয় বলিয়া “অন্বষ্ট” এ জাতির নাম “বৈদ্য” বা “অন্বষ্ট” হইল। ধন্বন্তরি অশ্বিনীকুমারের মানুষী কন্যা সিদ্ধ বিদ্যার পাণিগ্রহণ করিয়া, ধরাতলে চিকিৎসাবিশারদ বলিয়া প্রসিদ্ধ হইলেন। সিদ্ধবিদ্যার গর্ভে এবং ধন্বন্তরির ঔরসে সেন, দাস ও গুপ্ত এই তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। এই তিন জনের বংশধরেরা বৈদ্য জাতিরূপে বঙ্গদেশ ব্যাপিয়া পড়ে। পৌরাণিক মত ছাড়িয়া দিয়া পুরাণের সারভাগ গ্রহণ করিলে, ইহা প্রতীতি হইবে যে ব্রাহ্মণের ঔরসে বৈশ্যার গর্ভজাত পুত্র “বৈদ্য” বা “অন্বষ্ট” হইয়া বৈশ্য হইতে শ্রেষ্ঠ হইয়াছে। ইহা মনুর ব্যবস্থানুসারে সিদ্ধান্ত। ইহা দ্বারা ইহাও প্রমাণ হইল যে বৈদ্যেরা শূদ্রজাতীয় নহে; এবং বৈশ্য অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ও ব্রাহ্মণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট। ইহাদের মধ্যে যাহারা উপনীত, তাহারা ১৫ দিন এবং যাহারা উপনীত নহে, তাহারা একমাস অশৌচ গ্রহণ করেন। কোন স্থলে ইহাদের আচার ব্যবহার প্রায় ব্রাহ্মণ সদৃশ এবং কোন স্থলে কায়স্থের মত। ইহাদের জাতীয় ব্যবসা চিকিৎসা এবং ইহারা স্মৃতিশাস্ত্র পর্যন্ত অধ্যয়ন করিয়া থাকে। আদিশূর, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, রাজবল্লভ প্রভৃতি রাজগণ এই বংশোদ্ভব। “দানসাগর” নামক গ্রন্থে, সেনবংশের তাম্রশাসনে ও প্রস্তরফলকে ইহা প্রতিপন্ন হইবে যে বল্লালসেন চন্দ্রবংশীয় ব্রহ্ম-ক্ষত্র-কুলোদ্ভব বিজয়সেনের পুত্র। ইহাতে বৈদ্যজাতিকে ক্ষত্রিয় বলিলেও বলা যাইতে পারে। এইরূপ বৈদ্যজাতি সাধারণত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত, যথা- (১) বঙ্গজ, (২) রাঢ়ী, (৩) পঞ্চকোটি। রাজসাহীর বৈদ্যগণ বঙ্গজ শ্রেণিভুক্ত। ইহাদের অনেকে যশোহর জেলার অন্তর্গত সেনহাটি সমাজভুক্ত। যদিও ইহারা চিকিৎসক বলিয়া পরিচিত, ইহাদের অনেকেই চাকরি করিয়া জীবিকানির্বাহ করে। প্রায় সকলেরই অবস্থা ভাল। রাজসাহীতে ইহাদের সংখ্যা প্রায় ১১০০ কি ১২০০ হইবে। বেলঘরিয়া, পুঁঠিয়া, মরকটি প্রভৃতি গ্রামে বৈদ্যের বাস।