দীর্ঘদিন ধরে তাইওয়ানকে সুরক্ষিত রেখেছে এক অদৃশ্য প্রতিরক্ষা—সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। বিশেষ করে বিশ্বখ্যাত টিএসএমসি (TSMC)-এর উপস্থিতি দ্বীপটির নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এই ঢালকে দুর্বল করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে।
যুদ্ধের ভীতি ও প্রস্তুতি
তাইপের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কয়েক তরুণী ৪০ ডলার খরচ করে যুদ্ধকালীন মৌলিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাঁরা অনুশীলন করছেন, যদি চীন আক্রমণ করে, তাহলে কীভাবে আহত সহযোদ্ধাকে সরিয়ে নিতে হবে। এখন তাইওয়ানের রাজনীতিতে প্রধান প্রশ্ন—চীন কি আক্রমণ করবে?
চীনের বাড়তি চাপ
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তাইওয়ান দখলের পরিকল্পনা করে আসছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্বীপটিকে পুনর্দখলের ওপর জোর দিয়েছেন, যদিও তাইওয়ান কোনোদিন চীনের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে এখন অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বেইজিং চাইলে দ্বীপটিকে সহজেই অবরুদ্ধ করতে পারে।
বৈশ্বিক চিপশিল্পে তাইওয়ানের গুরুত্ব
তাইওয়ান বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টরের অন্যতম প্রধান উৎপাদক। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য ব্যবহৃত উন্নতমানের চিপের ৯০ শতাংশের বেশি এখান থেকেই আসে। ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের হিসাব অনুযায়ী, তাইওয়ানকে ঘিরে অবরোধ হলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হতে পারে—যার প্রভাব চীনকেও ভোগ করতে হবে।
টিএসএমসি: অদৃশ্য শক্তির প্রতীক
তাইওয়ানের চিপশিল্পকে বৈশ্বিক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে মূলত টিএসএমসি। চলতি বছরের জুলাইয়ে কোম্পানিটির বাজারমূল্য ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এটি অ্যাপল ও এনভিডিয়ার মতো শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকারী। আইফোন, ল্যাপটপ থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ডেটা সেন্টার—সব ক্ষেত্রেই টিএসএমসির চিপ অপরিহার্য।
সমাজে টিএসএমসির অবস্থান
যদিও কোম্পানিটি দৃশ্যমান কোনো পণ্য তৈরি করে না, তবুও টিএসএমসি তাইওয়ানের সমাজ ও রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। দক্ষিণের শহর তাইনানের বারে কিংবা তাইপের ট্যাক্সিচালকের মুখে প্রায়ই শোনা যায় একই বিশ্বাস—“তাইওয়ান নিরাপদ, কারণ আছে টিএসএমসি।”
সিলিকন ঢালের ধারণা
বিশ্লেষকদের মতে, টিএসএমসির কারণে তাইওয়ান আক্রমণ করলে বৈশ্বিক শক্তিগুলো অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিশোধ নিতে পারে। এই সম্ভাবনাই এক ধরনের প্রতিরোধক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ান বিজনেস কাউন্সিলের সভাপতি রুপার্ট হ্যামন্ড-চেম্বার্স বলেন, “টিএসএমসি এখন তাইওয়ানের সবচেয়ে পরিচিত প্রতীক, যা দ্বীপটির সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।”
ঢাল কি দুর্বল হয়ে পড়ছে?
তবে সাম্প্রতিক পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে টিএসএমসি নিজ দেশে বিনিয়োগ কমিয়ে আমেরিকায় নতুন কারখানা গড়ে তুলছে। এতে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষার প্রতীক হিসেবে যে সিলিকন ঢাল কাজ করছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়ছে কিনা—নতুন করে সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। টিএসএমসির উপস্থিতি কি সত্যিই দ্বীপটির জন্য সুরক্ষার ঢাল হয়ে থাকবে, নাকি কোম্পানির বিশ্বায়নের পথেই ভেঙে পড়বে এই প্রতিরক্ষা—তার উত্তর দেবে সময়ই।