ওয়াশিংটন, ১১ সেপ্টেম্বর: মাত্র চার মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের আমিরের সঙ্গে বৈঠকে তাঁর বিলাসবহুল প্রাসাদের প্রশংসা করেছিলেন এবং একটি বৃহৎ প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি কাতারে রয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা সেই সম্পর্ককে নাড়িয়ে দিয়েছে।
মঙ্গলবার দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো এই হামলায় ছয়জন নিহত হন, যার মধ্যে একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন। তবে হামাস নেতারা বেঁচে যান। এতে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং দোহা ও পশ্চিমা মিত্রদের তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছে ইসরায়েল।
ট্রাম্পের অসন্তোষ, তবে সম্পর্ক ছিন্ন নয়
ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েলের এই অভিযানের প্রতিটি দিক নিয়েই তিনি “অসন্তুষ্ট”। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের ইসরায়েল নীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না। বরং এই ঘটনাই দেখিয়েছে যে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ উপেক্ষা করতেও দ্বিধা করেন না।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলার আগে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। মঙ্গলবার ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে ফোন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি হামলার খবর পান মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে, সরাসরি ইসরায়েল থেকে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও অসন্তোষ
কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং গাজা সংকট নিয়ে আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই সেখানে ইসরায়েলের হামলা ট্রাম্পকে বিশেষভাবে বিরক্ত করেছে। এ ঘটনা তাঁকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, যখন ইসরায়েল হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছিল কোনো আগাম তথ্য না দিয়ে।
ট্রাম্প আগেও নেতানিয়াহুকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবুও তাঁর প্রশাসন হামাসকে দুর্বল করার ইসরায়েলি প্রচেষ্টায় জোরালো সমর্থন দিয়েছে এবং ইরান ইস্যুতেও ইসরায়েলকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশ্লেষক অ্যারন ডেভিড মিলার বলেন, “ট্রাম্প নেতানিয়াহুর কৌশল নিয়ে বিরক্ত। তবে তাঁর ধারণা হলো, হামাসকে শুধু সামরিকভাবে দুর্বল করলেই হবে না, তাদের মূল শক্তিকে ভাঙতে হবে।”
হোয়াইট হাউস মন্তব্যে ট্রাম্পের বক্তব্য তুলে ধরে জানায়, এই হামলা যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের স্বার্থ এগিয়ে নেয়নি। তবে ট্রাম্প লিখেছেন, গাজার মানুষের দুঃখকে কাজে লাগিয়ে হামাস যে লাভবান হচ্ছে, তাদের নির্মূল করা একটি “ন্যায্য লক্ষ্য।”
আরব বিশ্বের চাপ ও আব্রাহাম চুক্তি
কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, নেতানিয়াহু যদি ভবিষ্যতে এ ধরনের আকস্মিক পদক্ষেপ চালিয়ে যান, তাহলে ট্রাম্পের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। এতে গাজা আক্রমণে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমর্থন ফিরে নিতে পারে।
দোহায় হামলা ট্রাম্পের সেই আশা-কেও দুর্বল করবে, যেখানে তিনি চান আরও উপসাগরীয় দেশ আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিক। এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ও কয়েকটি আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিল।
তবুও সম্পর্ক ভাঙনের সম্ভাবনা কম। ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন বলেন, ট্রাম্প শক্তি ও যুদ্ধের সমাপ্তি আনে এমন লেনদেনকে মূল্যায়ন করেন। তাই সম্পর্ক অটুট থাকবে।
উত্থান-পতনময় সম্পর্ক
ট্রাম্প-নেতানিয়াহু সম্পর্ক বরাবরই উত্থান-পতনে ভরা। এক শীর্ষ হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা বলেন, “নির্বাচনী প্রচারণা থেকেই এই সম্পর্ক কখনো উষ্ণ, কখনো শীতল।”
মে মাসে ট্রাম্প সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করলেও ইসরায়েলকে এড়িয়ে যান। অনেকে একে ইসরায়েলের প্রতি অগ্রাহ্য বলে মনে করেছিলেন। তবে জুনে ইরানের ওপর ইসরায়েলি বিমান হামলার পর ট্রাম্প বি-২ বোমারু বিমান পাঠিয়ে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালান।
তবে এর কিছুদিন পরই তিনি ইরান ও ইসরায়েলকে একযোগে কঠোর সমালোচনা করেছেন, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছিল। জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলার সমালোচনা করে। আর কাতারে হামলার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে শেষ মুহূর্তে জানানো হলেও কোনো সমন্বয় করা হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জোনাথন পানিকফ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহু তাঁর দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবেন।”
এই ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু জোটের সম্পর্ক দৃঢ় হলেও এর ভেতরে রয়েছে দ্বিধা ও অবিশ্বাস। গাজা সংকট এবং উপসাগরীয় ভূ-রাজনীতির জটিলতার মধ্যে এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরীক্ষায় পড়বে।