নেপালে রাজনৈতিক সংকটের বিস্তার
নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা অজানা পথে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সহিংস আন্দোলনের সঙ্গে এর অদ্ভুত মিল দেখা যাচ্ছে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে জেন জেড প্রজন্মের ডিজিটাল আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ও তাঁর মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করেছে। এখন দেশ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে।
ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা
অস্থিরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্রের গুঞ্জনও ছড়াচ্ছে। নেপালের সিনিয়র সাংবাদিক ও সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়া (SAWM) এর সহসভাপতি নম্রতা শর্মা বলেন,
“৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ষড়যন্ত্রের চিহ্ন আমি দেখিনি। কিন্তু পরবর্তী ভাঙচুর ও নির্বিচার সহিংসতায় অচেনা ও বহিরাগত শক্তির ভূমিকা স্পষ্ট।”
তিনি আরও বলেন, “এটি জেন জেড আন্দোলনের অংশ ছিল না। বাইরের কিছু শক্তি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল এবং সুবিধাজনক সময়ে নেমে এসে আন্দোলনকে অন্য খাতে প্রবাহিত করেছে।”
বাংলাদেশের সঙ্গে মিল
ঢাকায় আগস্ট ২০২৪-এ শিক্ষার্থীরা বিতর্কিত কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে। দমন-পীড়নে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। শেষ পর্যন্ত নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হন।
শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা
শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ, মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ সংকট ও ঘাটতির কারণে গণবিক্ষোভ হয়। আন্দোলনকারীরা সরকারি ভবনে হামলা চালায় এবং সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এর ফলে গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। নেপালের মতোই সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা হলেও তা কেবল ক্ষোভ বাড়িয়েছিল।
সহিংসতার পেছনের প্রস্তুতি
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সি কে লাল মন্তব্য করেন,
“ষড়যন্ত্রকারীরা আগুন জ্বালিয়েছে কিন্তু নেভানোর ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে সমন্বিত আক্রমণ প্রমাণ করে এটি আগে থেকেই প্রস্তুত করা হচ্ছিল।”
তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মাত্র চার দিনের জন্য বন্ধ ছিল। এত অল্প সময়ে দেশব্যাপী এমন সহিংসতা সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
পার্থক্য ও ভিন্ন বাস্তবতা
নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত লোক রাজ বরাল বলেন,
“বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যান। কিন্তু নেপালে তেমন কিছু হয়নি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখনও এখানে রয়েছে এবং তারা দ্রুত ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।”
তবে তিনি বাইরের প্রভাব পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি। তাঁর মতে, দেশে এমন কিছু গোষ্ঠী রয়েছে যারা বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে।
ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা
নম্রতা শর্মা উল্লেখ করেন,
“নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত সংবেদনশীল। উত্তরে চীন আর দক্ষিণে ভারত, দুই শক্তিশালী প্রতিবেশীর মাঝখানে আমরা আটকে আছি। পাশাপাশি পশ্চিমা শক্তিগুলিও নেপালকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ফলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সবসময় থেকেই যায়।”
সতর্কতার আহ্বান
নেপালের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্টিন চৌতারির সিনিয়র রিসার্চার রমেশ পরাজুলি বলেন,
“সাধারণ মানুষের কাছে স্থিতিশীলতা সবসময় কাম্য। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের যুক্তি ভিন্ন। তারা মনে করেন অস্থিতিশীল রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করা সহজ। তাই প্রতিবেশী স্থিতিশীল থাকলে আমরা উপকৃত হলেও, বড় শক্তিগুলির চিন্তাভাবনা অন্য রকম।”
এই সংকট দেখিয়ে দিচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় আন্দোলনের ঢেউ এক দেশ থেকে আরেক দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং বহিরাগত শক্তিগুলির প্রভাব এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।