প্রাগৈতিহাসিক শিকারি
প্রায় ৭ কোটি বছর আগে দক্ষিণ পাটাগোনিয়ার স্যাঁতসেঁতে বন্যাপ্লাবিত সমতলে ঘুরে বেড়াত এক ভয়ঙ্কর মাংসাশী প্রাণী। এটি দেখতে ছিল বিশাল কুমিরের মতো, দৈর্ঘ্যে ১১.৫ ফুট (৩.৫ মিটার) পর্যন্ত এবং ওজনে প্রায় ২৫০ কেজি। এ প্রাণী যা পেত তাই শিকার করত—এমনকি ডাইনোসরও।
নতুন প্রজাতির আবিষ্কার
আর্জেন্টিনার দক্ষিণ প্রান্তে বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন এ প্রাণীর প্রায় সম্পূর্ণ কঙ্কাল, যার মধ্যে রয়েছে মাথার খুলি ও চোয়াল। প্রাণীটির নাম দেওয়া হয়েছে Kostensuchus atrox। এটি পেইরোসোরিড ক্রোকোডাইলিফর্মস-এর অন্তর্গত, যা আধুনিক কুমির ও অ্যালিগেটরের প্রাচীন আত্মীয়। এটাই প্রথমবার আর্জেন্টিনার চোরিয়ো ফর্মেশনে (Chorrillo Formation) এ ধরনের জীবাশ্ম পাওয়া গেল, যা ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষ ভাগের (১৪৫-৬৬ মিলিয়ন বছর আগে) সময়কার। এ পর্যন্ত পাওয়া এ গোষ্ঠীর সবচেয়ে সম্পূর্ণ কঙ্কাল এটি।
বৃহৎ শিকারি হিসেবে গুরুত্ব
গবেষকরা জানিয়েছেন, K. atrox ছিল এ অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিলুপ্ত শিকারি এবং এ ধরনের কুমির সদৃশ প্রাণীর অন্যতম বড় প্রতিনিধি। গবেষণার প্রধান লেখক ড. ফার্নান্দো নভাস এটিকে “বিড়ালদের মধ্যে সিংহের সমান” বলে উল্লেখ করেছেন।
চোরিয়ো ফর্মেশনের অন্যান্য জীবাশ্মে দেখা যায়, এ অঞ্চল ছিল বহুবৈচিত্র্যময় পরিবেশ যেখানে ডাইনোসর, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ ও এমনকি আধুনিক প্লাটিপাসেরও পূর্বপুরুষ বাস করত। বিশাল মাথা, শক্তিশালী চোয়াল ও বড় দাঁতের কারণে এ প্রাণী সহজেই তৃণভোজী ডাইনোসর শিকার করতে পারত এবং থেরোপড ডাইনোসরের মতো অন্যান্য মাংসাশীদের বিরুদ্ধে নিজের শিকার রক্ষা করতে সক্ষম ছিল।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি
নভাস বলেন, এত দক্ষিণে এ প্রজাতি পাওয়া যাওয়া প্রমাণ করে যে পেইরোসোরিড কুমিরেরা শুধু ব্রাজিল ও উত্তর পাটাগোনিয়ার উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা নাতিশীতোষ্ণ এলাকাতেও বাস করত।
দাঁত ও শিকার কৌশল
২০২০ সালের মার্চে ডাইনোসরের জীবাশ্ম খননের সময় দলটি এ কঙ্কাল খুঁজে পায়। এটি প্রায় সম্পূর্ণ অবস্থায় ছিল, শুধু লেজ ও কিছু অঙ্গ অনুপস্থিত। দাঁতের এনামেল পর্যন্ত অক্ষত ছিল। দাঁতগুলো ছিল ধারালো ও করাতের মতো কিনারা বিশিষ্ট, যা বড় শিকারীর মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য উপযোগী। ভঙ্গিতে আধুনিক কুমিরের তুলনায় কিছুটা সোজা হলেও, সামনের পায়ের গঠন দেখে ধারণা করা হয় এটি আধা-জলজ প্রাণী ছিল।
আধুনিক কুমিরের সঙ্গে তুলনা
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কিগান মেলস্ট্রম বলেন, এ ধরনের মিল convergent evolution-এর উদাহরণ, যেখানে আলাদা প্রজাতি একই রকম বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলে। তবে K. atrox আধুনিক কুমির থেকে আলাদা ছিল। এর নাসারন্ধ্র ছিল সামনের দিকে এবং চোখ ছিল মাথার দুপাশে, যেখানে আধুনিক কুমিরে চোখ ও নাসারন্ধ্র থাকে ওপরে, যাতে পানির নিচে শরীর লুকিয়ে রেখে শিকার পর্যবেক্ষণ করা যায়।
নভাসের মতে, কঙ্কালের গঠন নির্দেশ করে যে এ প্রাণী স্থলভাগে শিকার করত, যেখানে মাঝারি আকারের তৃণভোজী ডাইনোসর থাকত।
বিলুপ্তির কারণ
অত্যন্ত মাংসাশী হওয়া হয়তো একদিকে K. atrox-কে পরিবেশে আধিপত্য দিয়েছিল, আবার অন্যদিকে বিলুপ্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষে গণবিলুপ্তির সময় বড় আকারের এ ধরনের কুমিরেরা টিকে থাকতে পারেনি। তবে ছোট আকারের, বহুমুখী খাদ্যাভ্যাসের কুমিরেরা বেঁচে যায়। মেলস্ট্রম জানান, তার গবেষণা অনুযায়ী, হাইপারকার্নিভোর প্রজাতিগুলো গণবিলুপ্তিতে টিকে থাকার সম্ভাবনা কম থাকে।
ভবিষ্যৎ গবেষণা
বিজ্ঞানীরা এখন দাঁতের আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ ও শিকারের স্থান নির্ধারণ করতে চান। অস্থির অভ্যন্তরীণ গঠন বিশ্লেষণ করলে এ প্রাণীর বৃদ্ধি ও বয়স সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এছাড়া মেরুদণ্ডে পাওয়া অস্বাভাবিকতাও আরও গবেষণার দাবি রাখে। নভাসের মতে, এ কঙ্কাল ভবিষ্যতে আরও নতুন তথ্য উন্মোচন করতে পারে।