বঙ্গজ কায়স্থ ঐ ৯৯ পদ্ধতির কায়স্থবংশ মধ্যে যাহারা বঙ্গে বাস করেন, তাহারা কান্যকুব্জাগত কায়স্থগণের বংশধর। তাহাদিগের গুণানুসারে কৌলীন্য মর্যাদা প্রদান করেন। এই নিয়মানুসারে বসু, ঘোষ, শুহ ও মিত্র উপাধিধারী কায়স্থ বঙ্গের কুলীন হইলেন। দত্ত, নাগ, নাথ ও দাস উপাধিধারী কায়স্থ মধ্যল্য এবং সেন, কর, দাম, পালিত, চন্দ্র, পাল, রাহা, ভদ্র, ধর, নন্দী, দেব, কুণ্ড, সোম, রক্ষিত, অঙ্কুর, সিংহ, বিষ্ণু, আঢ্য এবং নন্দন এই ১৯টি উপাধিধারী কায়স্থ মহাপাত্র নামে পরিচিত হইল। অবশিষ্ট সর্বগুণবিহীন কায়স্থগণ যথা-হোড়, স্মর, ধরণী, আইচ, খুর, শর্মা, বর্মা, গুপ্ত প্রভৃতি দ্বিসপ্ততিবংশ “বাহাত্তরে কায়স্থ” বলিয়া কীর্তিত হন। বল্লাল সেনের কৌলীন্যপ্রথা প্রচলিত হওয়ার পরে, বঙ্গজশ্রেণি কায়স্থগণের মেল বন্ধ এবং তাহাদের মধ্যে কুলপ্রথার পরিবর্তন ঘটে, তাহার বিস্তারিত বিবরণ লিখা বাহুল্য বিবেচনায় এ ক্ষুদ্র পুস্তকে সন্নিবেশিত হইল না। এই সম্বন্ধে কেবল দুই একটি কথা উল্লেখ করা গেল। কুলীনের সমঘরে কন্যাদান ও কন্যাগ্রহণ করাই উত্তম কার্য। কুলীনের সকল সন্তান পিতার মত কুলমর্যাদা পাইয়া থাকেন, যদি আদান প্রদানে কুলভ্রষ্ট না হইয়া থাকেন। বল্লাল সেনের পর “বংশজ” নামে একটি শ্রেণি গঠিত হয়। যাহারা কুলীনের বংশজাত অথচ কুলহীন, তাহারাই “বংশজ” নামে প্রসিদ্ধ হইল।
দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ কান্যকুব্জাগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সঙ্গে যে পঞ্চ কায়স্থ বঙ্গদেশে আইসেন, তাহাদের বংশধরগণ মধ্যে কেহ বঙ্গে এবং কেহ দক্ষিণ রাঢ়ে বাস করেন। যাহারা দক্ষিণ রাঢ়ে বাস করেন, তাহারাই দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ আখ্যা প্রাপ্ত হইলেন। এই পঞ্চ কায়স্থের অধস্তন সন্তানের কয়জন রাঢ়ে এবং কয়জন বঙ্গে বাস করেন, তাহারা তালিকা নিম্নে দেওয়া গেল
(ক) “সম্বন্ধ নির্ণয়ে” ভবনাথ মকরন্দ ঘোষের পুত্র বলিয়া স্থির হইয়াছে, কিন্তু “কায়স্থ বংশাবলীতে” মকরন্দ ঘোষের সুভাষিত ও পুরযোত্তম, এই দুই পুত্র লিখিত আছে। ভবনাথ পুরুষোত্তমের পুত্র। এই ভবনাথের বংশধরগণ দক্ষিণ রাঢ় সমাজে ঘোষ বংশীয় কুলীন।
(খ) কৃষ্ণ বসুর তিন প্রপৌত্র, শুক্তি, মুক্তি, অলঙ্কার। শুক্তি ও মুক্তি রাঢ় ভূমে বাস বসুবংশীয় কুলীন। করেন। অলঙ্কার পুনর্বার বঙ্গে আগমন করেন। শুক্তি ও মুক্তির বংশধরগণ দক্ষিণ রাঢ় সমাজে
(গ) দক্ষিণ রাঢ় সমাজের মিত্রগণ শ্রীধরের বংশধর। অশ্বপতির অতি বৃদ্ধ প্রপৌত্র জয়ী মিত্রের ঔরস পুত্র না হওয়াতে “পোষ্য পুত্রে কুলং নাস্তি” এই নিয়মানুসারে বঙ্গসমাজে জয়ী মিত্রের বংশের কুল নাই।
(ঘ) বিরাজ বিরাটের পুত্র নহে। বিরাটের একজন অধস্তন সন্তান। “কায়স্থ বংশাবলীতে” বিরাজের কোন উল্লেখ নাই। দক্ষিণ রাঢ় সমাজে বিরাজের বংশধর কুলীন নহে। কিন্তু বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে নারায়ণের বংশধরগণ গুহবংশীয় কুলীন।
(ঙ) “সম্বন্ধ নির্ণয়ে” পুরুষোত্তমের নারায়ণ নামে এক পুত্র ছিল বলিয়া কীর্তিত হয়; এবং পুরুষোত্তম বা তাহার বংশধরগণ মধ্যে কেহ বঙ্গে যান নাই। কিন্তু “কায়স্থ-বংশাবলীতে” দেখা যায় যে পুরুষোত্তমের অন্যতম পুত্র অর্ক দত্ত বঙ্গে বাস করেন। নারায়ণ দত্ত হাবড়া জেলার অন্তর্গত বালি গ্রামে বাস করেন।
“ঘোষ বসু মিত্র কুলের অধিকারী।
অভিমানে বালির দত্ত যায় গড়াগড়ি।।”
এই বালির দত্ত নারায়ণের বংশধর।
দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থসমাজে ঘোষ, বসু ও মিত্র কুলমর্যাদা প্রাপ্ত হন। কিন্তু দত্ত কুলমর্যাদা প্রাপ্ত হন না। এই দক্ষিণ রাঢ়ীয় সমাজে দত্ত ও গুহ মৌলিক মধ্যে গণ্য। দক্ষিণ রাঢ়ী ও বঙ্গজ কায়স্থের আচার, ব্যবহার, রীতি, নীতি প্রায় এক প্রকার। তবে যে সামান্য বিভিন্নতা কোন কোন স্কুলে দেখা যায়, তাহা ভিন্ন ভিন্ন দেশে বাস জন্যই। আজিকালি বঙ্গজ সমাজের সঙ্গে দক্ষিণ রাঢ়ীয় সমাজের কায়স্থগণ বৈবাহিক সূত্রে সম্বন্ধ বিস্তারের সূত্রপাত করিতেছেন। ইহা অযুক্তির কথা নহে, যেহেতু দক্ষিণ রাঢ়ী ও বঙ্গজ কায়স্থগণের আদি বংশের কোন পার্থক্য দেখা যায় না।
উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ-উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থগণ কান্যকুজাগত পঞ্চ কায়স্থের বংশধরগণ বলিয়া পরিচয় দেন না। ইহারা গৌড় দেশীয় কায়স্থ বলিয়া প্রসিদ্ধ। ইহাদের মধ্যে বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত নাই। এই শ্রেণি কায়স্থ সর্বসমেত সাড়ে সাত ঘর। এই সাড়ে সাত ঘরে করণকারণ হয়। এই শ্রেণি কায়স্থ মধ্যে দুই প্রকার ঘোষ এবং দুই প্রকার দাস আছে। এক শ্রেণির ঘোষ সৌকালীন গোত্র আর এক শ্রেণির ঘোষ শাণ্ডিল্য গোত্র। এক শ্রেণির দাস মৌদগল্য গোত্র এবং আর এক শ্রেণির দাস কাশ্যপ গোত্র। আবার ভরদ্বাজ গোত্রীয় সিংহ এক পোয়া এবং মৌদগল্য গোত্রীয় কর এক পোয়া। দুই শ্রেণির ঘোষ ২, দুই শ্রেণির দাস ২. মিত্র ১, সিংহ ১, দত্ত ১, সিংহ।০, কর ।০, এই মোট ৭।।০ ঘর উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ আছে। এই ৭।।০ ঘর মধ্যে সৌকালীন গোত্রীয় ঘোষ এবং বাৎস্য গোত্রীয় সিংহ শ্রেষ্ঠ। ইহাদের আচার ব্যবহার বঙ্গজ বা দক্ষিণ রাঢ়ীর বা বারেন্দ্র কায়স্থদের অপেক্ষা অনেক প্রভেদ।
বারেন্দ্র কায়স্থ এই গ্রন্থের স্থানান্তরে বারেন্দ্র কায়স্থের উৎপত্তির বিষয় বর্ণনা করা হইয়াছে। ইহাদের কান্যকুব্জাগত পঞ্চ কায়স্থের বংশধর বলিয়া পরিচিত করা কঠিন। কিন্তু ঢাকুর গ্রন্থে ইহা লিখিত আছে যে “সিদ্ধ-সাধ্যভাবে সাতটি বংশ লইয়া যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত আছে, সেই সামাজিকগণই উপনিবেশি বারেন্দ্র কায়স্থ। ইহাদের পূর্বপরুষগণ কান্যকুব্জ দেশ হইতে গৌড় দেশে আগমন করেন। বরেন্দ্র আদি নিবাসী আচারভ্রষ্ট কায়স্থদের সহিত ইহাদের সংজব নাই।” যে পঞ্চ কায়স্থ কান্যকুব্জ হইতে বঙ্গদেশে প্রথমবার আগমন করেন, তাহাদের উপাধি ঘোষ, বসু, গুহ, মিত্র ও দত্ত। যাহারা দ্বিতীয়বারে ঐ পঞ্চ কায়স্থ সঙ্গে বঙ্গদেশে আইসেন তাহাদের উপাধি নাগ ও নাথ। কিন্তু বারেন্দ্র কায়স্থ মধ্যে ঘোষ, বসু, ওহ ও মিত্র উপাধি দেখা যায় না। কেবল নাগ ও দত্ত উপাধি দেখা যায় এবং তাহারা বারেন্দ্র কায়স্থ সমাজে কুলীন নহে। দত্ত বংশের আদি পুরুষ পুরুষোত্তম। সেই পুরুষোত্তম দত্তের বংশসম্ভূত যে বারেন্দ্র কায়স্থের দত্ত, তাহারাও কোন প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায় না। ঐরূপ নাগবংশেরও কোন প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায় না। সম্ভবত গৌড়দেশীয় কায়স্থগণের বংশধরেরা বরেন্দ্রভূমে বাস নিবন্ধন বারেন্দ্র কায়স্থ বলিয়া পরিচিত। উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থগণের ন্যায় বারেন্দ্র কায়স্থের বল্লালী মর্যাদা নাই। পদ্যস্কুল পঞ্জিকাতে ইহা লিখিত আছে যে ভৃগু নন্দী, নরহরি দাস ও মুরারি চাকী বল্লাল সেনের রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া বরেন্দ্র প্রদেশে আইসেন এবং শৌল-কুপায় নাগবংশীয় জমিদারদিগের সাহায্যে বারেন্দ্র কায়স্থ সমাজ সংস্থাপিত করেন। এই ভৃগু, নরহরি ও মুরারির বংশধরগণ বরেন্দ্রভূমে (রাজসাহী, বগুড়া, পাবনা, মুরশিদাবাদ জেলা) ব্যাপিয়া পড়েন। রাজসাহী বিভাগ বারেন্দ্র কায়স্থের প্রধান স্থান। এই বারেন্দ্র কায়স্থের সংখ্যা সর্বসমেত সাড়ে সাত ঘর, যথা-দাস, নন্দী, চাকী, শর্মা, নাগ, সিংহ, দেব, দত্ত; তন্মধ্যে দাস, নন্দী ও চাকী এই তিন ঘর কুলীন। ইহা কথিত আছে “শর্মা” পূর্বে নাপিত ছিল, তাহাকে কৌলীন্য মর্যাদা দিয়া অর্ধঘর কুলীন করা হয়। এই “শর্মা” সম্বন্ধে ঢাকুর গ্রন্থে যেরূপ প্রতিবাদ করা হইয়াছে তাহা এস্থানে উদ্ধৃত করা গেল। “কেহ কেহ এই সমাজকে সাড়ে সাত ঘর বলেন এবং ঈর্ষাপরবশ হইয়া এই সমাজের অযথা কলঙ্ক ঘোষণা করিয়া থাকেন। ইহার কারণ এই যে ‘নরসুন্দর শর্মা’ নামে একজন নিচবৃত্তি পরায়ণ কায়স্থ বহুদিন ভৃগুনন্দীর বৈতনিক ভৃত্য ছিল। যৎকালে ভূগুনন্দী প্রভৃতি সমাজ বন্ধন করেন সেই সময় শর্মা, সমাজপতিদিগকে বলেন, আমি আপনাদিগের আশ্রয়ে বহুকাল আছি এবং যাহা অনুমতি করিতেছেন তাহাই সম্পাদন করিতেছি কিন্তু আপনাদিগের দ্বারা আমার কিছুই উন্নতি হইল না। অতএব আমি আর এখানে থাকিব না। শর্মার এই কথা শুনিয়া সমাজপতিগণ কৌতুক করিয়া বলেন আচ্ছা তোমাকেও আমরা সমাজে গ্রহণ করিয়া অর্ধভাবাপন্ন করিব। শর্মা এই কথা সর্বত্র প্রচার করাতে প্রবল প্রতাপ জটাধর নাগ মহাশয় তাহাকে দূর করিয়া দেন। শ্রুত হওয়া যায় নাটোর ডাঙাপাড়া গ্রামে শর্মার বংশ আছে। শর্মা যে সমাজে গৃহীত হয় তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।” শর্মা বাহাত্তরে কায়স্থের অন্যতম উপাধি। ২১ আমাদের বিশ্বাস বারেন্দ্র কায়স্থ সমাজ সাতঘর।
নরহরি দাস, ভৃগু নন্দী, মুরারি চাকী ও জটাধর নাগের বংশবিস্তার বর্ণন করিলে রাজসাহী প্রদেশের বারেন্দ্র কায়স্থের ঐতিহাসিক বিবরণ অনেক জানা যাইবে।