আমরা এতক্ষণ সাধারণ অত্যাচারে কথা বলিতেছিলাম; এক্ষণে দেবীসিংহের উদ্ভাবিত অত্যাচারের কতিপয় দৃষ্টান্ত দেখাইতেছি। দেখিবেন, এরূপ পাশবিক অত্যাচার কখনও সম্ভবপর কি না! শত বৎসরের পর সেই সমস্ত অত্যাচার পড়িতে গেলে, উপন্যাস বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু তাহা উপন্যাস বা কাহিনী নহে, জ্বলন্ত সত্য। মনুষ্য-প্রকৃতিতে এরূপ পিশাচপ্রকৃতির সমাবেশ আর কোথাও আছে কি না জানি না।
দেবীসিংহের পাইকবর্গ সেই নিরীহ প্রজাগণের অঙ্গুলিতে রজ্জু বন্ধন করিয়া, ক্রমাগত পাক দিতে দিতে অঙ্গুলিগুলির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিত এবং তাহারা যখন যন্ত্রণায় কাতর হইয়া, আর্তনাদ করিয়া উঠিত, সেই সময়ে হাতুড়ির দ্বারা তাহা চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া, একেবারে অকর্মণ্য করিয়া দিত। গ্রামের মণ্ডল, পঞ্চায়েৎ ও অন্যান্য প্রধানবর্গের দুই দুই জনকে শৃঙ্খলে বাঁধিয়া পদদ্বয়- উদ্ধ মুখে ও মস্তক অধোমুখে লম্বমান করিয়া, পদতলে বেত্রাঘাত করিতে করিতে, অঙ্গুলি হইতে নখগুলি বিচ্যুত করিয়া দিত; অবশেষে অস্তকে আঘাত করিয়া মুখ, চক্ষু ও নাসিকা হইতে রুধির বহির্গত না করিয়া ক্ষান্ত হইত না।
বেত বা লাঠীর দ্বারা যদি পদে অধিক কষ্ট বোধ না করে, এই ভাবিয়া সেই কুতান্তের অনুচরেরা কণ্টকপূর্ণ বিন্ধ-শাখার দ্বারা তাহাদের ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরও ক্ষত বিক্ষত করিত: তাহার উপর বিছুটির আঘাত করিয়া অপরিসীম যন্ত্রণায় তাহাদিগকে মৃতকর করিয়া তুলিত। রাত্রিতেও তাহাদিগের নিস্তার ছিল না। প্রত্যেক রাত্রিতে তাহাদিগকে তিন বার করিয়া বেত্রাঘাত করার নিয়ম ছিল। পরে তাহাদিগকে প্রবল শীতে, নগ্ন দেহে দণ্ডায়মান করিয়া রাখা হইত। প্রভাত হইলে, তুষারশীতল জলে নিমজ্জিত করিয়া, পুন-ঝাঁর বেত্রাঘাত করিতে করিতে, গ্রামমধ্যে লইয়া গিয়া, লুক্কাইত অর্থের জন্য পীড়াপীড়ি করিত।
বৃক্ষতল ব্যতীত যাহাদের অবলম্বন নাই, তাহারা অর্থ কোথায় পাইবে, ইহাও কি পিশাচদিগের মনে উদয় হইত না? তাহার পর আবার কারাগারে প্রেরণ। ক্রমে ক্রমে নূতন নূতন অত্যাচারের উদ্ভাবন হয়। পিতার সম্মুখে তাহার স্নেহপুত্তলী শিশুসন্তানকে রজ্জবদ্ধ করিয়া তাহার সুকোমল দেহে ক্রমাগত বেত্রাঘাতের লীলা চলিতে থাকিত। সেই বেত্রাঘাতে বালকগণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া, রুধিরস্রোতে পিতার মুখমণ্ডল প্লাবিত করিত। পুত্র যন্ত্রণায় এবং পিতা হৃদয়ভেদী দৃক্ষে মুর্জিত হইয়া, ভূতলে পড়িয়া যাইত।